জি-৭ সম্মেলন শেষে জেনেভায় বাইডেন-পুতিনের শীর্ষ বৈঠক
ইংল্যান্ডের সমুদ্র-তীরবর্তী অবকাশ যাপনকেন্দ্র কারবিস বেতে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসসে ন্যাটো সম্মেলন এবং সবশেষে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাইডেন-পুতিনের বহুল আলোচিত মুখোমুখি সাক্ষাৎ ও শীর্ষ বৈঠক- এমনতর বড় বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে সপ্তাহ খানেক ধরে ইউরোপ বেশ সরগরম। এই লেখা যখন লিখছি, স্থানীয় সময় রাত পৌনে নটা, তখন সপ্তাহখানেক ধরে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সময় কাটিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘এয়ার ফোর্স ওয়ানে’ চড়ে উড়াল দিলেন ওয়াশিংটন ডিসি-র উদ্দেশ্যে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়া। এই সকল সম্মেলনকে ঘিরে ইউরোপে জড়ো হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সহ বিশ্বের ধনী দেশের সরকার প্রধানরা। এবারের জি-৭ সম্মেলন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন গোটা বিশ্ব একদিকে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, বেলেরুশ, তুরস্ক, মিয়ানমার সহ বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচার সরকারের কার্যকলাপ, দমননীতি গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর এই প্রথম দেশের বাইরে সরকারি-সফরে বের হলেন। বের হলেন এমন সময় যখন খোদ তার নিজ দেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে। কেননা রিপাবলিকান পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতায়, ভোটের-আইন পরিবর্তন করে এমন সব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে চলেছে যাতে ডেমোক্র্যাট-দলীয় ভোটাররা বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারেন। আর তাই জো বাইডেন যখন জি-সম্মেলন থেকে গণতন্ত্র লংঘিত হচ্ছে বলে চীনের তীব্র সমালোচনা করেন, তখন আমরা দেখি চীনকে ‘নিজ ঘরে আগে গণতন্ত্র সামলাও’ বলে যুক্তরাষ্ট্রকে উল্টো পরামর্শ দিতে। জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেবার আগে জো বাইডেন প্রথমে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জনসনকে এক সময় বাইডেন মিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে রাজনীতিতে সব কিছু ঘটে। আজকের শত্রু আগামীকালের বন্ধু হলে অবাক হবার কিছু নেই। সে আমরা অতি সমপ্রতি দেখি ইসরায়েলের নতুন ৮-দলীয় সরকারি জোটে আরব-দলকে ভিড়তে, অথচ একটির সাথে অন্যটির কী নীতিগত ফাঁরাক।
জো বাইডেন যে নতুন ‘বার্তা’ নিয়ে তার এই হপ্তাব্যাপী সরকারি সফরে বের হয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক এগেইন’। আমেরিকা আবার ফিরে এসেছে। এর অর্থ কী? আমেরিকা কি হারিয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ, হারিয়ে গিয়েছিল বৈকি। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলে পরিচিত কিংবা দাবীদার আমেরিকা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত চার বছরের শাসনামলে গণতন্ত্রের ট্র্যাক থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কায়েম করেছিলেন এমন এক রাজত্ব যা চলেছিল এক-ব্যক্তির ইচ্ছে ও খুশিমত, একেবারে স্বৈরাচারী স্টাইলে। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছেন ‘আনপ্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট’ হিসাবে পরিচিত ডোলান্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসে ট্রাম্প সরে এসেছিলেন প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি থেকে, সরে এসেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে, সরে এসেছিলেন ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে, সরে এসেছিলেন ইউনেস্কো থেকে। সরে আসার হুমকি দিয়েছিলেন ন্যাটো থেকেও। এই সংস্থাটিতে এতদিন ধরে যে অনুদান যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে আসছিল তাও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছিলেন তিনি এবং জার্মানি সহ বাকি সদস্যদের বাধ্য করেছিলেন তাদের দেয়া চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’- এই নীতিতে ট্রাম্প এমনতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশ্ব নেতাদের অসুন্তুষ্টি সৃষ্টি করে। জো বাইডেন ক্ষমতায় বসার সাথে সাথে ট্রাম্পের নেয়া পদক্ষেপগুলি উল্টিয়ে দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় ফিরিয়ে আনেন উল্লেখিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতে। ট্রাম্প বিগত চার বছরে আন্তর্জাতিক বলয়ে আমেরিকার যে সম্মান ও ইমেজ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, তা ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বাইডেন। আর তাই তিনি সবাইকে এই বলে আস্বস্ত করছেন, ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক এগেইন’।
ইউরোপ তথা মিত্র-দেশগুলির ‘আস্থা’ ফিরিয়ে আনার জন্যে বাইডেনের এই ইউরোপ-সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, আমেরিকা ও ইউরোপ এক সূত্রে গাঁথা এবং বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্যে এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। তবে তার এই আশ্বাসবাণীতে ইউরোপীয় মিত্রদের কতটুকু নির্ভরতা আছে তাতে প্রশ্ন থেকে যায়, কেননা অনেকে মনে করেন, নিজ ঘরে (যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্র বড্ড নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং ২০২৫ সালে যে ট্রাম্প-সময়কালীন ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হলেও ট্রাম্পকে এখনো সে দেশের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প যে আবারো ২০২৫ সালে ফিরে আসবেন না এবং ক্ষমতায় এলে তিনি তার নেয়া পুরানো পদক্ষেপে ফিরে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর সে কারণে জো বাইডেন তার সফরের শুরু থেকে যে ‘টোনে’ মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ বিশ্বে চীনের আগ্রাসনকে ঠেকানোর জন্যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন তাতে একই সুরে সুর মেলাতে খুব একটা রাজি নয় ইউরোপের কোন কোন দেশ, বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালী। তারা মনে করে চীনকে একঘরে করে রাখা বা এইভাবে আক্রমণ করা ঠিক হবে না।
যে কথা বলছিলাম। এই প্রথম বাইডেনের পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ নয়। এর আগে তিনি দু-দুবার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে এবং তারও আগে সিনেট ফরেন-কমিশনের সদস্য হিসাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন, এমন কী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। বাইডেন-পুতিন এই শীর্ষ আলোচনা এমন সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন দিন দুয়েক আগে জি-৭ এর নেতারা ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইবার হামলা চালানোর জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান’। পুতিন-বাইডেন বৈঠকে যে সমস্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে এই বিষয়টি ছাড়াও ছিল, রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেঙে নাভালনি সহ অন্যান্য বিরোধী নেতাদের দমন, গ্রেপ্তার, প্রতিবেশি রাষ্ট্র বিশেষ করে ইউক্রেইন বর্ডারে সামরিক সরঞ্জাম ও মহড়া প্রদর্শন, ২০২০-মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার নাক-গলানো, দু-দেশের বন্ধ-থাকা দূতাবাস পুনরায় খোলা এবং দু-দেশের বন্দী বিনিময়। তবে তার সবগুলিতে যে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে তেমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছেনা। সম্মেলন শেষে পুতিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেন, ‘আলোচনা অর্থবহ হয়েছে এবং বিরাজমান সমস্যা সমাধানের জন্যে দু-পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে’। উল্লেখ্য, সামপ্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে বলা চলে ‘তলানীতে’। দু-দেশের দূতাবাস গেল এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে। পুতিন বলেন দু’দেশে তা খুলে দেয়া হবে এবং এই ব্যাপারে কাজ শুরু হবে শীঘ্র। বাইডেন এবং পুতিন তাদের আলোচনাকে ‘ইতিবাচক’ ও ‘গঠনমূলক’ হিসাবে বর্ণনা করেন। উভয় নেতা সাইবার-নিরাপত্তার বিষয়ে পরামর্শ শুরু করতে সম্মত হন। সম্মেলন শেষে আমেরিকা ও রাশিয়া এক যৌথ বিবৃতিতে বলে, ‘এমনকি উত্তেজনামূলক সময়েও উভয় দেশ সশস্ত্র দ্বন্দ্ব ও পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস করার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। আজ আমরা পুনরায় নিশ্চিত করে বলতে চাই যে পারমাণবিক যুদ্ধে কারো জয়ী হওয়া সম্ভব নয় এবং কখনো লড়াই করাও সঠিক হবেনা। এই লক্ষ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমেরিকা ও রাশিয়া অদূর ভবিষ্যতে দ্বি-পাক্ষিক কৌশলগত সংলাপে যোগ দেবে। এই সংলাপের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করবো।’ এদিকে এই শীর্ষ বৈঠকের সমালোচনা করেছেন রিপাবলিকান দলের কেউ কেউ, এমন কী নিজ দল, ডেমোক্রেটিক পার্টিরও জনা কয়েক নেতা। তাদের মতে পুতিনের সাথে এই ধরনের একান্ত শীর্ষ-বৈঠক মানে তার (পুতিন) তাবৎ তাদের ভাষায় ‘অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ কার্যকলাপকে স্বীকৃতি দেয়া। এই ধারণা সঠিক নয় বলে বাইডেন বলেন, ‘এটি হচ্ছে কূটনীতির একটি পর্যায়। এমন কী প্রয়োজনে এবং বৃহৎ স্বার্থে শত্রুর সাথেও আলোচনায় বসা যায়।’ তবে যে সমস্ত বিষয় যা ইংরেজিতে বলা হয় ‘কমন গ্রাউন্ড’ এই দুই নেতার আলোচনায় উঠে এসেছে যেমন ক্লাইমেট চেইঞ্জ, সামরিক শক্তি হ্রাস এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, তাতে হয়তো কিছু সুফল দেখা দিতে পারে। তেমনটি হলে বাইডেনের এই প্রচেষ্টা অনেকটা সফল বলা যেতে পারে। এখন দেখা যাক কি হয়। কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বিশ্বের এই দুই শীর্ষ নেতার শীর্ষ বৈঠক। আসন্ন দিনগুলিতে কী সুফল বয়ে আনে গোটা বিশ্বের জন্যে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট