চট্টগ্রাম–৮ আসনের মাননীয় সাংসদ, জননেতা আলহাজ্ব মোছলেম উদ্দিন আহমদ আর নেই। দিনের শুরুতেই এই দুঃসংবাদের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। মনটা বেদনায় মুষড়ে পড়লো।
মোছলেম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮২ সালে। জাতীয় শিশু–কিশোর সংগঠন কচি–কাঁচার মেলার তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা সংগঠক। আমি ছিলাম জেলা কমিটির সদস্য। উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কচি কাঁচার মেলার শাখা। ওয়াসা ভবনের বিপরীতে হাই লেভেল রোডস্থ মোছলেম ভাইয়ের বাসভবনের নীচ তলা ছিল জেলা সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়। শিশু–কিশোর সংগঠনটির সৃজনশীল কাজ– কর্মের সুবাদে তাঁর এতই নৈকট্য লাভ করেছিলাম যে, সম্পর্কটা গড়িয়েছিল বড় ভাই–ছোট ভাইয়ের মতো। কয়েক বছর পর মোছলেম ভাই রাজনীতিতে সক্রিয় ও জেলা কমিটির সদস্যরা স্ব স্ব পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে কচি কাঁচার মেলার কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু, মোছলেম ভাইয়ের সাথে গড়ে ওঠা আমার ভ্রাতৃপ্রতিমম সম্পর্ক ছিল অটুট।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শকে বুকে ধারণ করে যাঁরা ‘ভোগ নয় ত্যাগ‘ এর মনোভাব নিয়ে রাজনীতি করতেন তাঁদেরই একজন মোছলেম ভাই। দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দলের দুর্দিনে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়েছেন নিজ কর্মী– অনুসারীদের। রাজনীতিতে সততা, দক্ষতা মোছলেম ভাইকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চাসনে। জেল–জুলুম সহ্য করেছেন, শত প্রতিকূল অবস্থায়ও রাজপথ ছাড়েন নি, রাজনীতির সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন যে নেতা তিনি মরহুম আলহাজ্ব মোছলেম উদ্দিন আহমদ। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন সফল নেতা। জিয়া–এরশাদ আমলে মন্ত্রীত্ব সহ অনেক লোভনীয় অফার এসেছিল এই নেতার কাছে। নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি মোছলেম ভাইকে। যেখানে আওয়ামী লীগের অনেক ডাকসাইটে নেতা ক্ষমতার লোভ সংবরণ করতে পারেন নি, সেখানে মোছলেম ভাইদের মত নির্লোভ নেতারা ছিলেন দলের সম্পদ। জিয়া ও এরশাদ আমলে কারাবরণ করেছেন একাধিক বার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদ একজন সুবক্তা ছিলেন। রাজনীতির উপর পড়াশোনা করেছেন প্রচুর। চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে জ্ঞানী ও উচ্চ শিক্ষিত নেতাদের মধ্যে মোছলেম ভাই ছিলেন একজন। সাহসী ঠিকানা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছিলেন কর্মীবান্ধব নেতা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে সফলতার তিন যুগ অতিক্রম করেছেন কিংবদন্তি এই রাজনীতিবিদ।
]মোছলেম ভাইয়ের নিজ উপজেলার নাম বোয়ালখালী। প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনিই ছিলেন বোয়ালখালী সংসদীয় আসনের একমাত্র হকদার। দুর্ভাগ্য, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রাপ্য হক পান নি। রাজনীতির সমীকরণে বারবার হয়েছেন বলী। তবুও, বৃহত্তর স্বার্থে নেত্রী ও দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। দেখিয়েছেন ত্যাগ ও আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা। একবার মোছলেম ভাইকে বলেছিলাম, ‘সারা জীবন দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেন কিন্তু ফল করল অন্যজন’। তিনি হাসি মুখে বললেন, ‘সেটাই তো নিয়ম’। যাক, ২০২০ সালের উপ–নির্বাচনে বোয়ালখালী আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জীবন সায়াহ্নে হলেও পেয়েছিলেন দীর্ঘকালের রাজনীতিতে তাঁর ত্যাগের স্বীকৃতি। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন মোছলেম ভাই। আজ একটি স্মরণীয় স্মৃতিচারণ করে আমার লেখা শেষ করবো। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট করোনা কালীন সময়ে মোছলেম ভাই ফোন করলেন আমাকে। ঐদিন ১৩ মিনিটের ফোনালাপে আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক অনেক বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া ছাড়াও আশির দশকে শিশু–কিশোর সংগঠন কচি–কাঁচার মেলার বিভিন্ন স্মৃতি চারণ করেন আমার অগ্রজতুল্য এই প্রিয় মানুষটি। কথা প্রসংগে সেদিন তিনি আমাকে একটি উপদেশ দিয়েছিলেন তা হলো– ‘কেউ সমালোচনা করলে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সমালোচনাকে উপেক্ষা কর। এতে মানসিক ভাবে লাভবান হবে’। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহার্শিবাদ ধন্য ষাটের দশকের তুখোড় সাবেক ছাত্ররা একে একে চির বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ভদ্র, মার্জিত, মেধাবী ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ মোছলেম উদ্দিন আহমদকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক