সাইবার ঝুঁকিতে সমাজ : দমনে নতুন অধ্যাদেশ নিয়ে কিছু কথা

আচিন জান্নাত মিম | শুক্রবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সমাজে সাইবার অপরাধের পরিমাণ এবং ধরন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ও পরিবর্তিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, আর্থিক প্রতারণা, অনলাইন হয়রানি, সাইবার বুলিং, ভুয়া তথ্য প্রচারসহ বিভিন্ন অপরাধ ব্যক্তি, সমাজ এবং অনলাইন বিজনেসের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার ঘটনাও বাড়ছে, যেখানে ক্রেতারা ভুয়া ওয়েবসাইট ও ইমেইলের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন যা অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর উদ্বেগজনক হারে সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় সরকার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ প্রণয়ন করেছে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন এই আইনে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, ভুয়া ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতারণা, বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া থাকছে সাইবার স্পেসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশের দণ্ড। বিশেষত, সামাজিক অস্থিরতা রোধ, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রতিরোধে এবং শিশুকিশোরদের সুরক্ষার জন্য নতুন বিধানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই অধ্যাদেশের ধারা ১৮তে অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ধারা ২৫এ সাইবার অপরাধের শাস্তির বিধান উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ধারা ৬ অনুসারে ‘সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল’ গঠনের নির্দেশনা রয়েছে এবং ধারা ৮ অনুযায়ী অনলাইনে ক্ষতিকর কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব আইনের প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। একদিকে, বিশেষত ধারা ২৫এর সাইবার বুলিং সংজ্ঞা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। অন্যদিকে, শৈল্পিক ও শিক্ষাগত মূল্যবোধহীন কনটেন্টের প্রচার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও, এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত এবং সমালোচনার সুযোগ সীমিত করার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এছাড়াও সাংবাদিকদেরও এই ধারা মাথায় নিয়ে সংবাদ করতে হবে যেটা নিরপেক্ষতায় প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪এর ধারা ৩৫ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রদান করে। এই ধারা অনুসারে, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাইবার অপরাধের সন্দেহে কোনো ব্যক্তির স্থাপনা, যানবাহন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস তল্লাশি করতে এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি জব্দ করতে পারে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম। ধারা ৩৫এর এই ক্ষমতা প্রদান অর্থাৎ পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়ায়। এই ধারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে।

তবে, সাইবার আইন ২০২৩ মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে অপরাধের সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ ছিল কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে অপরাধের ধরন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তার কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান অধ্যাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা গণমাধ্যম এবং অধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নতুন অধ্যাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পূর্বের আইনের তুলনায় ভিন্ন। পূর্বের আইনে আদালতকেন্দ্রিক তদন্তের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

তবু প্রশ্ন রয়ে যায় এই অধ্যাদেশ কতটা কার্যকরী হবে। অধিকন্তু সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪আরো কার্যকরী করার জন্য আইনের প্রয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা এবং সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো পর্যালোচনা করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। তাছাড়া, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা উন্নত করতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রদান করা, আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইন হালনাগাদ করাও গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্দেশনা যেমন : কমার্স এবং অন্যান্য অনলাইন ব্যবসার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করাটাও জরুরি। সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৪ সামগ্রিকভাবে ডিজিটাল অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হলেও, আইনের অস্পষ্ট সংজ্ঞা ও প্রয়োগের অসামঞ্জস্যতা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তিগত ও আইনগত বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আইনটির সংশোধন ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি হালনাগাদকরণসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি সুরক্ষিত ডিজিটাল পরিবেশ গড়ে তুলতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

লেখক :শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়ক ডিভাইডার চাই
পরবর্তী নিবন্ধপুতুল বধূ