সমকালের দর্পণ

ইসলামের অনুকরণীয় আদর্শ আর অনুপম মাহাত্ম্য

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৯ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আমার পাঠকদের পবিত্র রমজান মাসের আন্তরিক শুভেচ্ছা। রমজানুল মোবারক। এ মাসটি গুরুত্ব বিবেচনায় ইসলামের ইতিহাসে এক মহিমাযুক্ত পরম পবিত্র মাস। এ মাসে মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তার প্রিয় নবী (সঃ) এর কাছে পবিত্র কোরান নাজিল হয়, অষ্টম হিজরীর শুক্রবার ২০ রোযার দিন মুসলমানরা মক্কা বিজয় করেন। শিরোনামে লিখতে গিয়ে একটু পিছন ফিরে দেখি। আমি যখন মায়ানমারে কর্মরত তখন একসময়ের আকিয়াব তথা বর্তমানের সিটওয়ের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম সাহেবদের আমার বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসতাম। বলাবাহুল্য এটা করতাম প্রায় শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর। ইমাম সাহেবদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। একেকদিন একেকটি নির্দিষ্ট বিষয়। সেদিন আমি ইমাম সাহেবদের সামনে যে বিষয়টি তুলে ধরি সেটি ছিল এরকম ‘হুজুর আমার ছেলে ক্যাথলিক স্কুলে পড়ে, একই স্কুলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শির্ক্ষাথী যেমন খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন্য, ইত্যাদি ছাত্ররাও পড়ালেখা করে, তাদের মাঝে তুমুল তর্ক, কার ধর্ম শ্রেয়? এখন হুজুর আপনারা বলেন, আমার ছেলে কীভাবে প্রমাণ করবে যে তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। হুজুররা মুখচাওয়াচাওয়ি করে তাদের মধ্যে যিনি মুরুব্বি তিনি বললেন ‘ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের আসমানি কিতাব রয়েছে’। আমি বললাম খ্রিষ্টান, ইহুদিদেরও আসমানি কিতাব আছে। তারা আরো দু একটি যুক্তি উপস্থাপন করেন, যে সব যুক্তির মাধ্যমে আমার ছেলের পক্ষে তার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ সহজতর হওয়ার কথা নয়। আমি তখন তাদের সামনে ১৯৭৮ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত মাইকেল হার্টের ‘দি হানড্রেড’ বইটির কথা টেনে আনি। এ বইটিতে পৃথিবী সৃষ্টি থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মানুষদের মাঝে শ্রেষ্ঠ মানুষদের একটি ক্রমিক তালিকা উপস্থাপন করা হয়। সে তালিকা তৈরিতে ক্রমান্বয়ে যাচাই বাছাই করতে করতে দেখা যায় ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এক নাম্বারে স্থান করে নিয়েছেন। এটি কীভাবে সম্ভব এবং কেন হল তার উত্তর দিতে গিয়ে মাইকেল হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ বই এ যে সমস্ত যুক্তি তুলে ধরেছেন তা যদি আমার ছেলে জানে তাহলে তার ধর্ম যে শ্রেষ্ঠ সে প্রমাণ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। হুজুরদের সে কথা বলে আমি তাদের যা বলেছিলাম তার মূল অংশ এখানে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্মের পূর্বে তার বাবা আবদুল মোতালেব ইন্তিকাল করেন।

জন্মের পর পরই তার মা ইন্তেকাল করেন। এতিম মোহাম্মদ (সঃ) দাদা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন।

শৈশব থেকে নবী মোহাম্মদ (সঃ) কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। সত্যবাদিতার জন্য মাত্র ১২ বছর বয়সে আরবের সেই আইয়ামে জাহালিয়াতের যুগে ‘আল আমিন’ তথা সত্যবাদী উপাধি প্রাপ্ত হন।

৪০ বছর বয়সে নবী মোহাম্মদ (সঃ) নবুয়ত প্রাপ্ত হন। সেই নবুয়তের প্রথম বানী ‘ইকরা বিসমে রাব্বিকাল লাজি খালাক’ পড় তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। কী অপূর্ব অর্থপূর্ণ, অন্ধকার আরব জগতে পড়া লব্ধ জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার অমোঘ আহবান। প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ করা হয়, জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সদূর চীন দেশে যেতেও আদেশ করা হয়। মাইকেল হার্টের বক্তব্য যে মানুষ কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন তার কাছ থেকে এই অনুপম বাণী যেটি নিঃশ্চিতভাবে তার চিন্তা প্রসূত নয় বরং মহান আল্লাহ প্রেরিত বাণী তার প্রিয় নবী (সঃ) এর কাছে।

নবুয়াতের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণে চারদিক যখন আলোকিত হচ্ছিল তখন প্রবল বাধাও এসে হাজির হয় মোহাম্মদ (সঃ) এর সামনে। সংঘাতে না জড়িয়ে নবী মোহাম্মদ (সঃ) হিজরত করেন মক্কা থেকে মদিনায়। মদিনার মানুষ মোহাম্মদ (সঃ) কে সাদরে অভ্যর্থনা জানান।

এর পর ইসলাম প্রচারে মোহাম্মদ (সঃ) কে আরোপিত যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয়। সেই সব যুদ্ধে তাকে সেনাপতি হিসাবে যুদ্ধ পরিচালনাও করতে হয়। যুদ্ধ যাত্রায় সৈন্যদের প্রতি তার (সঃ) কি মানবিক শিক্ষণীয় আদেশ ‘তোমাদের যাত্রা পথে কোনো শস্যের মাঠ, কোনো ধর্মীয় উপসনালয়, কোনো শিশু, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা নারী পুরুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়’ আদেশের কী অর্থ কী মানবিকতা যুদ্ধের ময়দানেও।

যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে যুদ্ধে আহতও হতে হয়। যুদ্ধ জয়ের পর যুদ্ধে তাকে সন্ধি স্থাপন করতে হয়। সেই সব সন্ধির শর্তও ছিল অনুপম অনুকরণীয়, যেমন দুইজন মুসলিম আমাম বা অশিক্ষিতকে শিক্ষিত করলে একজন যুদ্ধ বন্দী মুক্তি পাবে।

নবী মোহাম্মদ (সঃ) নেতৃত্বে আরবের একটির পর একটি জনপদ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। ক্রমাগত ইসলামী শাসন পৃথিবী ব্যাপী ব্যাপ্তি লাভ করতে থাকে।

বিদায় হজ্বের বাণী, মানব জাতির প্রতি সেকি এক উদাত্ত আহবান, ভেদাভেদহীন এক মানব সমাজ গঠনের জন্য। নরনারীর সমতা, কালো আর সাদা গায়ের রঙ দিয়ে মানুষকে বিচার না করতে, আরাব অনআরব পার্থক্য না টানতে।

নবী মোহাম্মদ (সঃ) এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পরও ইসলামের প্রচার বা প্রসার থেমে থাকেনি। ইসলাম যে ক্রম প্রসারমান তার প্রমাণ হিসাবে মাইকেল হার্ট উল্লেখ করেছেন পৃথিবীব্যাপী যেখানেই সংঘাত সেটি ইসলাম বনাম অন্য ধর্মাবলম্বী। যেমন ফিলিস্তিনে ইহুদি বনাম ইসলাম, বসনিয়া হার্জেগোবেনিয়ায় খ্‌্রীস্টান বনাম ইসলাম, মায়নমারে বৌদ্ধ বনাম ইসলাম, কাশ্মীরে হিন্দু বনাম ইসলাম। এই সংঘাত সংঘর্ষ প্রমাণ করে ইসলাম ক্রম সম্প্রসারণশীল যার জন্য অন্যের সাথে তার সংঘর্ষ হচ্ছে। সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে মাইকেল হার্ট স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তে আসেন নবী মোহাম্মদ (সঃ) পৃথিবী সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে একক প্রভাবশালী মানুষ যার মাধ্যমে পৃথিবীর এত এত মানুষ প্রভাবিত হয়েছেন।

প্রভাবের এই প্রভায় মানুষ যে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তার একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ না করলে নয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রঃ) সিরিয়া সফরে গেছেন। সিরিয়ার গভর্নর তখন হজরত আবু উবায়দা (রঃ)। সফরের এক পর্যায়ে খলিফা হজরত উমর (রঃ) হজরত আবু উবায়দা (রঃ)’র সাথে রাতে আহার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে হজরত আবু উবায়দা (রঃ) বিনয়ের সাথে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। হজরত উমর (রঃ)’র পীড়াপীড়িতে হজরত আবু উবায়দা (রঃ) বলেন আমি যে আহার গ্রহণ করি মাননীয় খলিফা তা আপনি গ্রহণ করতে পারবেন না। অবশেষে হজরত উমর (রঃ)’ র একান্ত আগ্রহে হজরত আবু উবায়দা (রঃ) তার সামনে খাবার পরিবেশন করেন। পরিবেশিত খাবারের প্রতি হজরত উমর (রঃ) অবাক হয়ে দেখে থাকেন। একটি বাটিতে লবণ পানি মিশ্রিত একটি ছাতুর রুটি। হজরত উমর (রঃ)’ হজরত আবু উবায়দা (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেন ‘আবু উবায়দা তুমি এই খাবার গ্রহণ কর? বায়তুল মাল থেকে যে সম্মানী তুমি পাও তা দিয়ে তো তুমি এর চেয়ে অনেক ভালো খাবার খেতে পার।

হজরত আবু উবায়দা (রঃ) এর উত্তরে জানান ‘এয়া খলিফাতুল মুসলেমিন বিষয়টি টাকা পয়সার বা সামর্থ্যের নয়, বিষয়টি আমার নবী করিম (সঃ) এর জীবিত কালে তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন ‘আবু উবায়দা আমি তোমাকে এই দুনিয়ায় যে ভাবে রেখে যাচ্ছি হাশরের ময়দানেও যেন তেমনি ভাবে পাই’ হজরত উমর (রঃ) এর উদ্দেশ্যে এতটুক বলে হজরত আবু উবায়দা (রঃ) জানান সেদিন আমার নবী(সঃ) এর কাছে ওয়াদা করেছিলাম, আমাকে তিনি যেভাবে দুনিয়ায় রেখে যাচ্ছেন আখেরাতেও সেভাবে পাবেন। এই ওয়াদাকালীন সময়ে আমি এই ছাতুর রুটিই খেতাম, এখন আপনি বলুন আমি কি করে আমার নবী (সঃ) কে দেওয়া ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হব? সেই থেকে আজ অব্দি আমি ছাতুর রুটিই খাই এবং বাকী জীবনও তাই করব। ইসলামের দুই মহান ব্যক্তিত্ব সেদিন হয়ত পারলৌকিকতার প্রবাল আলোয় ডুবেছিলেন অনেক্ষণ। এ থেকে সৎ জীবন, ওয়াদা খেলাপ না করার এবং স্বীয় নবী (সঃ) প্রতি দেওয়া ওয়াদার প্রতি অবিচল থাকার এক মহান শিক্ষাই আমরা গ্রহণ করতে পারি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ’, তিনিই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক।

খালিদ বিন ওয়ালিদ। অষ্টম হিজরীর সফর মাসের ১ম দিন নবী করিম (সঃ)-এর হাতে হাত রেখে পবিত্র ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে শামিল হন। সেই থেকে ২১ হিজরীতে তার মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বলাবাহুল্য এসব যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ(রঃ) কখনো পরাজয় বরণ করেননি। উল্লেখ্য এই বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী খ্যাত জার্মান জেনারেল রোমেলকে তার সাফল্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন তিনি খালেদ বিন ওয়ালিদের সাহস দূরদর্শিতা আর কৌশল অবলম্বন করেন। নবী করিম (সঃ) খালিদ বিন ওয়ালিদকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহ’র অসি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ইসলামের এই অপারাজেয় সেনাপতিকে হজরত উমর (রঃ) তার শাসনকালীন সময়ে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এ নিয়ে ইসলামি সমর ইতিহাসবিদদের মাঝে নানা মতের সৃষ্টি হয়। হজরত উমর (রঃ) তার এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। অজেয় সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের প্রতি সাধারণ মানুষের এমন এক বদ্ধমূল ধারণা জন্মাতে থাকে যে খালেদ চাইলেই যে কোনো যুদ্ধ জয় অসম্ভব নয়, এতে করে মহান রাব্বুল আল আমিনের হুকুমে যে সবকিছু সংঘটিত হয় সেই আস্থার উপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ছায়াপাত ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে অপসারণ করে হজরত উমর (রঃ) মহান রাব্বুল আমিনের হুকুমে জয় পরাজয় সব নির্ধারিত সেই অমোঘ সত্য সাধারণ মানুষের মনে প্রোত্থিত করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ অবনত মস্তকে হজরত উমর (রঃ) আদেশ পালন করে আবু ওবায়দার অধীনে একজন সাধারণ সৈনিকের জীবন যাপন করতে থাকেন।

ইসলামের ইতিহাসের এই অমিত বীর মৃত্যু শয্যায় শায়িত। তার এক বন্ধু এসেছেন তাকে দেখতে সেই বন্ধুকে খালেদ কাছে ডেকে বললেন ‘দেখত আমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন নাই এমন কোনো অংশ আছে কিনা। তার বন্ধু দেখে বললেন না তেমন কোনো অংশ নেই। অশ্রুসিক্ত নয়নে খালেদ বিন ওয়ালিদ তখন বললেন ‘প্রতিটি যুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে আমি যুদ্ধের ময়দানে একটি শহীদি মৃত্যু চেয়েছি, আমি এমনই হতভাগ্য আমার শহীদি মৃত্যু হয়নি’ একথা শোনার পর তার বন্ধু উত্তরে বলেন ‘যে দিন আল্লাহ’র রাসুল (সঃ) আপনাকে সাইফুল্লাহ বা আল্লাহ’র তলোয়ার ঘোষণা করেছেন সেদিনই যুদ্ধের ময়দানে আপনার মৃত্যু হারাম হয়ে গেছে, কারণ আল্লাহ’র তলোয়ার কখনো যুদ্ধের ময়দানে লুঠিয়ে পড়তে পারে না’। হিজরীর ২১ সালে সিরিয়ার হামাসে ‘সাইফুল্লাহ’ ইহকাল ত্যাগ করেন। এখানেই তিনি সমাধিস্থ।

পৃথিবীর ইতিহাসের এক অসাধারণ বীর খালেদ বিন ওয়ালিদ যিনি ২০০ (দুইশত) যুদ্ধে অপারাজেয় ছিলেন তার মুত্যুর পর হিসাব নিতে গিয়ে দেখা গেল তার রেখে যাওয়া সম্পদ শুধু তার প্রিয় তলোয়ার আর ঘোড়া।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধসারাদেশে ৯৩টি উন্নত মাছ শুকানোর র‌্যাক বিতরণ করবে এফএও