ইসরায়েলে হামাসের নজির বিহীন হামলার মধ্য দিয়ে ৫০ বছর আগের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের সমর্থনে বিক্ষোভ হচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ইসরায়েলকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে। হামাসকে সমর্থন দিচ্ছে ইরান এবং এর আঞ্চলিক মিত্রদেশ লেবাননের হেজবুল্লাহ।
ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের গত শনিবারের হামলায় অন্তত ৭০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন; আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই হাজার। অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলায় ৪১৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ২ হাজার ২০০ জন। কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা এই তথ্য জানিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েল সরকারের প্রেস অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের হাতে ১০০ ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক নাগরিক অপহৃত বা জিম্মি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েক দশকের মধ্যে গত শনিবার ভোরে ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস। দিনটি ছিল ইহুদিদের ছুটির দিন। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা রকেট হামলা চালানোর পাশাপাশি সুপরিকল্পিতভাবে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ ব্যবহার করে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে পড়ে। তারা কয়েক ঘণ্টা ইসরায়েলি শহর ও সেনাচৌকি অবরুদ্ধ করে রাখে। অভিযানে বেশ কিছু ইসরায়েলি নিহত হয়। কিছু ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করে গাজায়ও নিয়ে যায় ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা। পরে শনিবার সকাল থেকে পাল্টা হামলা শুরু ইসরায়েলি সেনারা। এতে দুই পক্ষের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এই ঘটনায় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করেছে। এই হামলা–পাল্টা হামলার ঘটনার পক্ষে বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।
ইসরায়েল শনিবার রাতভর গাজার বিভিন্ন হাউজিং ব্লক, সুড়ঙ্গ, মসজিদ এবং হামাস কর্মকর্তাদের বাড়িতে বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র চলমান হামলায় এরই মধ্যে ধ্বংস হয়েছে হামাসের কার্যালয়, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশাপাশি বহু ঘরবাড়ি ও অন্যান্য ভবনও। বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় ছেয়েছে চারিদিক। আকাশে ইসরায়েলি ড্রোনের চক্কর দেওয়ার শব্দও ভেসে আসছে। ইসরায়েলি সেনারা এবার আবাসিক ভবনগুলোতে হামলার সময় আগের মতো আর কোনও পূর্ব সতর্কতা জারি করেনি। গাজার কেন্দ্রস্থলের একটি শরণার্থী শিবিরে আশেপাশের লোকজন ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করছে। গাজার দক্ষিণের খান ইউনিসে লোকজন গতকাল রোববার সকালে একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষে লাশের সন্ধান শুরু করেছে। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, আমরা রাতের নামাজ পড়া শেষ করতে না করতেই হঠাৎ মসজিদে বোমা হামলা হয়। তারা শিশু, প্রপ্তবয়স্ক আর নারীদেরও আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। ইসরায়েলের এক সামরিক মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমরা হামাসের ওপর তীব্র হামলা চালাব এবং এই যুদ্ধ খুবই দীর্ঘ হবে।
ওদিকে, গাজায় হামাসের মুখপাত্র আব্দেল–লতিফ–আল–কানুয়া বলেছেন, আমাদের জনগণের প্রতিরক্ষার খাতিরেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলে রকেট হামলা এবং অভিযান এখনও চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
৫০ বছর আগে ইসরায়েলে মিসর ও সিরিয়ার আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল চতুর্থ আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ। শনিবার ইসরায়েলে হামাসের সবচেয়ে বড় এবং প্রাণঘাতী হামলার মধ্য দিয়ে সেই পরিস্থিতিরই পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দিলেও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের সমর্থনে বিক্ষোভ হচ্ছে। লেবাননের রাজধানীতে গাজাপন্থি বিক্ষোভ হচ্ছে। উড়ছে ফিলিস্তিন এবং হেজবুল্লাহর পতাকা। ইরান এবং হেজবুল্লাহ হামাসের ইসরায়েলে হামলা প্রশংসা করেছে। দক্ষিণ লেবাননে হেজবুল্লাহ মিলিশিয়া লক্ষবস্তুতে ইসরায়েলের হামলায় সংঘাত গাজার বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের এ সংঘাতে ভেস্তে যাওয়ার মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব–ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টা।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। অন্যদিকে, হামাসকে সমর্থন দিচ্ছে ইরান এবং এর আঞ্চলিক মিত্রদেশ লেবাননের হেজবুল্লাহ। ২০০৬ সালে হেজবুল্লাহ গেরিলারা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এবারে হেজবুল্লাহকে সংঘাতে না জড়ানোর ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছেন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র। কিন্তু লেবাননের হেজবুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা উত্তরে ইসরায়েলের অধিকৃত সেবা ফার্ম এলাকায় একটি রাডারস্থলসহ তিনটি পোস্টে রকেট এবং গোলা হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলও এর জবাবে দক্ষিণ লেবাননে গোলা হামলা চালিয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি হামলা যুদ্ধ বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ারই আভাস দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের সমর্থনে বিক্ষোভ হচ্ছে। ইরান এবং হেজবুল্লাহ হামাসের ইসরায়েলে হামলা প্রশংসা করছে। লেবাননে হামাসের নেতা ওসমান হামদান বলেছেন, শনিবারের অভিযানের পর আরব দেশগুলোর উপলব্ধি করা উচিত যে, ইসরায়েলের নিরাপত্তাসংক্রান্ত দাবি মেনে নিলেই তা শান্তি বয়ে আনবে না।