দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন, রোগী সংক্রমণ ও শনাক্তে নতুন রেকর্ড হতে যাচ্ছে চলতি জুলাই মাসেই। এরপর অগাস্টের পরিস্থিতি আগের সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে। তাঁদের আশঙ্কা, ঈদযাত্রা-গরুর হাট আর কেনাকাটায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত থাকায় মধ্য অগাস্টে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি সামলাতে আরেকদফা লড়তে হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি রাখার কথা বললেও বাড়তি সেই চাপ সামলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ী তাঁরা।
বলা বাহুল্য, মহামারীকালের গত দেড় বছরে এখনই সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থা চলছে বাংলাদেশে। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে গত এপ্রিল থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল। মে মাসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জুলাই মাসে এসে আগের সব রেকর্ড ভাঙছে। জুন মাসে যেখানে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জুলাইয়ের ২০ দিনেই তা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জনের মৃত্যুর বিপরীতে জুলাইয়ের ২০ দিনেই সাড়ে ৩ হাজার মৃত্যু দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে।
তাই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানার জন্য প্রচেষ্টা যেমন থাকতে হবে, তেমনি সরকারের লকডাউন কর্মসূচিকে সফল করার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। তবে দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করছে সরকার। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার জন্য নিবন্ধনের ন্যূনতম বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম বলেন, ‘টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধনের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর করে দেওয়া হবে। এটার ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় আমাকে জানিয়েছেন। আমরা এটা আমাদের কমিটিতে আলোচনা করব এবং কীভাবে এটা করা যাবে সেটা আমরা জানাব।’
এক সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও টিকার নিবন্ধনের ন্যূনতম বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করার পরিকল্পনার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটি টিকার জন্য নিবন্ধনের বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করার সুপারিশ করেছে। তিনি বলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েদের তাড়াতাড়ি স্কুল-কলেজে পাঠাতে চাই। শিক্ষকদের টিকা দিচ্ছি, এখন ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যারা আছে, তাদেরও টিকার আওতায় নিয়ে আসব।”
বাংলাদেশে গত ২৬ জানুয়ারি টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়। শুরুতে ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের টিকার জন্য নিবন্ধন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে তা তিন ধাপে কমিয়ে ৩০ বছরে নামিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ, যাদের বয়স ৩০ বছর বা তার বেশি, কেবল তারাই এখন সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে গিয়ে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছেন। তবে মহামারী মোকাবেলায় সম্মুখসারির কর্মী, বেশ কিছু পেশাজীবী শ্রেণি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, প্রবাসী কর্মী এবং প্রাধিকার তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা নির্ধারিত বয়সসীমার বাইরেও নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছেন। খুরশীদ আলম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা ১৮ বছর করার বিষয়ে কাজ শুরু করবেন। গ্রাম পর্যায়ে প্রান্তিক মানুষকে কীভাবে আরো সহজে টিকা দেওয়া যায় সে বিষয়টি নিয়ে সরকার ভাবছে বলেও জানান তিনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় এনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক দফা চেষ্টা করেও খুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি সংক্রমণ পরিস্থিতির বার বার ওঠা নামার কারণে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, ঈদের আগে দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধে তেমন প্রভাব দেখা যায়নি। তবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ কমেছে। এখন থেকে যে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে, সেটা কয়েকদিন গেলে বোঝা যাবে। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদেরকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে এটা আমি জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই, সরকারের ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট ভালো আছে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা মিশিয়ে বা ডোজ অদল বদল করে প্রয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও। এ বিশ্ব সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলেন, যেহেতু এর ভালো-মন্দ দিক নিয়ে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য নেই, সেহেতু ওই পরিকল্পনা একটি বিপজ্জনক ধারা তৈরি করবে। এটা খানিকটা বিপজ্জনকই বটে। টিকার মিক্স আর ম্যাচ করা নিয়ে আমাদের হাতে এখন পর্যাপ্ত তথ্য নেই, প্রমাণ নেই। এখন নাগরিকরাই যদি ঠিক করতে শুরু করে যে কে কখন দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ ডোজ নেবে, তাহলে সেটা দেশে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।
বিশ্বের ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণ টিকা মজুদ করে ফেললেও উন্নয়নশীল বা অনুন্নত অনেক দেশ এখনও টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে করোনাভাইরাস মহামারী সামলাতে এসব দেশকে রীতিমত নাকাল হতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই কোম্পানির টিকা মিশিয়ে, অথবা এক ডোজে এক টিকা নেওয়ার পর অন্য ডোজে অন্য কোম্পানির ভ্যাকসিন নেওয়া যায় কি না, সেই প্রশ্ন বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরছে। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকায় বিশেষজ্ঞরা ওই ভাবনাকে কখনোই উৎসাহ দেননি।