লাক্ষা মাছ সারা বিশ্বে ‘সাদা মাংশের’ জন্য জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে জনপ্রিয় শুটকি হিসেবে। এই মাছের কথা শুনলেই যেন শুটকি প্রেমিদের জিভে জল চলে আসে। কিন্তু সেই স্বাদের মাছ এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বঙ্গোপসাগর থেকে। কক্সবাজারের জেলেরা বলছেন, গত ৩ দশকে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৯৫ শতাংশ লাক্ষ্যাই হারিয়ে গেছে। ছোট হয়ে গেছে আকারেও। বিজ্ঞানীদের মতে, এই মাছটি মারাত্মকভাবে আহরিত হয়ে এখন প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে।
কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাটে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মাছের ব্যবসা পরিচালনা করে আসা জুলফিকার আলী বলেন, ফিশারিঘাটে আগে যেখানে দৈনিক ২শ পিসের বেশি লাক্ষ্যা মাছ পাওয়া যেত, সেখানে এখন পাওয়া যায় মাত্র ৭/৮টি; তাও আকারে ছোট। তিনি জানান, আগে ১৫ থেকে ১৮ কেজি ওজনের লাক্ষ্যা মাছ পাওয়া যেত। আর এখন পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৭/৮ কেজি ওজনের। কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে লাক্ষ্যা, তাইল্যা ও রূপচাঁন্দা টাইপের বেশ কিছু মাছ আশংকাজনক হারে কমে গেছে। যার ফলে আগে যেখানে এসব মাছ ধরার জন্য কয়েকশ বড়শি বোট ছিল, সেখানে এখন আছে মাত্র ২০/২৫টি। শুটকি হিসাবে কক্সবাজারে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় লাক্ষ্যা।
বাজারে লাক্ষ্যা শুটকির দাম কেজি প্রতি অন্য শুটকি তুলনায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি। তবু পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী বড় লাক্ষ্যা এখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান শহরের শুটকি ব্যবসায়ী আবদুর রহমান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের প্রফেসর, সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, লাক্ষ্যা মাছ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ও মূল্যবান মাছ। এই মাছটি মারাত্মকভাবে আহরিত হয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এছাড়া তাইল্যা, রূপচাঁন্দা ও পোয়া টাইপের বিশেষ করে দামী এবং বড় আকৃতির মাছ এখন খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। বাজার পর্যবেক্ষণ থেকেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, বেশ কিছু মাছের ধারাবাহিক আমরা বছরের পর বছর ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এটা নির্দেশ ৫ম পৃষ্ঠার ৭ম কলাম
করে যে, সমুদ্রে তাদের পরিমাণ কমে গেছে বলেই বাজারে তাদের জোগানও কম। তিনি বলেন, চিংড়ি মাছের বহু প্রজাতিও হুমকির মুখে। আমরা গবেষণায় দেখেছি। তবে আরো বিস্তারিত গবেষণা ছাড়া চূড়ান্ত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে সনাতনী পদ্ধতিতে কাঠের তৈরি ট্রলার, মাঝারি ট্রলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার ব্যবহৃত হয়। দেশে অগভীর সাগরে মাছ ধরায় যুক্ত আছে ৭০ হাজারের বেশি নৌযান। এছাড়া ৪০ মিটারের অধিক গভীরতায় মাছ শিকারের জন্য ২৫৩টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযান রয়েছে। আর এসব নৌযানে মৎস্য শিকারের সঙ্গে যুক্তরা ছোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জেনে এবং অগভীর সাগরে এসে নির্বিচারে মাছ শিকার করায় লাক্ষ্যা, তাইল্যাসহ অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন মাছগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে বলে মনে করেন সনাতনী পদ্ধতিতে মাছ ধরা ট্রলারের মালিকরা। এছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় মৎস্য আহরণে প্রতিবেশী দুটি দেশের নৌযানের অবৈধ অনুপ্রবেশ একটা নিয়মিত সমস্যা বলে জানান স্থানীয় জেলেরা।
জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় প্রায়ই ভারত ও মিয়ানমারের মাছ ধরা ট্রলার ঢুকে পড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের সীমানায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকাকালীনও তাদের উপস্থিতি বেড়ে যায়।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, দক্ষিণ দিকে সেন্টমার্টিন অংশে মিয়ানমার এবং পশ্চিমে চালনার দিকে ভারতীয় জাহাজ প্রায়ই অবৈধ মাছ শিকার করে। অনেক সময় একাধিক জাহাজ নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতীয় জাহাজ সাগরে মাছ ধরতে আসে বলেও তাদের নজরে পড়ে। এছাড়া দেশের অত্যাধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো অগভীর সাগরে এসে মাছ ধরে। আর এসব ট্রলার থেকে কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুটকি মহালে প্রতিদিন ছুরি মাছের ব্লক আসে। অথচ এই ধরনের মাছ ৪০ মিটারের অধিক গভীরতায় পাওয়ার কথা নয়। তিনি অভিযোগ করেন, মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়েও চট্টগ্রাম শহর থেকে নাজিরারটেকে ছুরি মাছের ফ্রোজেন ব্লক এসেছে। মৎস্য বিভাগ কয়েকবার মাছবোঝাই ট্রাকও আটক করেছিল।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, দেশের সমুদ্র সীমায় এসে বিদেশী জাহাজ মাছ ধরছে কিনা এবং অত্যাধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো অগভীর সাগরে এসে মাছ ধরে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা কোস্টগার্ড ও নৌ-বাহিনীকে অনুরোধ জানিয়েছি। আর কোনো ট্রলার যাতে ভবিষ্যতে অগভীর সাগরে এসে মাছ ধরতে না পারে, সেজন্য ট্রলারগুলোতে জিপিএস কিট লাগানো হবে।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) এর কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, দেশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্রের বাইরে আমরা ইতোমধ্যে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে লাক্ষ্যা, তাইল্যা ও ভেটকিসহ পোপা টাইপের মাছের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করেছি। তিনি আশা করেন, লাক্ষ্যার মত দামী মাছগুলোকেও ইলিশের মতোই গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করা হলে হারিয়ে যেতে বসা মাছগুলো আবার মানুষের খাবার টেবিলে ফিরে আসবে।
বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশের লাক্ষ্যা মাছ ইন্ডিয়ান স্যামন হিসাবেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এটি স্যামনডা পরিবারের কয়েকটি রে-ফিন্ড ফিশ প্রজাতির অন্যতম। কথিত রয়েছে, এ মাছটি যেখানে ডিম থেকে জন্ম নেয়, সেখানেই আবার ডিম পাড়তে আসে। শত শত বছর ধরে চলে আসা এ কিংবদন্তির প্রমাণও পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। ভূ-রসায়নবিদ ও জীবাশ্মবিদদের মতে, বয়স নির্ধারণী পরীক্ষায় এই মাছটি নিওজিন পিরিয়ডেই পৃথিবীতে উৎপত্তি হয়েছে (২ কোটি ৩০ লাখ বছর থেকে ২৫ লাখ ৮৮ হাজার বছর আগে অতিবাহিত) বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।