অব্যবস্থাপনা আর ভুল নীতির কারণে দেশের রপ্তানি খাতে দীর্ঘদিন চলছে ভঙ্গুর দশা। কিন্তু এর প্রকৃত চিত্র আড়াল করে রপ্তানি খাতে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়ে আসছিল বিগত সরকার। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং বিভিন্ন সূচকে কারসাজি করতে এমন আত্মঘাতী কাজে লিপ্ত ছিল বিগত সরকার। তবে বর্তমানে প্রকৃত হিসাব তুলে আনার পর রপ্তানি খাতের আয়ে বড় পতন দেখা দিয়েছে। এমন অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। এতে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস তৈরি পোশাক খাতেই বড় ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক বা এপ্রিল–জুন সময়ে রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) থেকে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার; যা আগের প্রান্তিক বা জানুয়ারি–মার্চ সময়ে আসা রপ্তানি আয়ের তুলনায় ৩৬ দশমিক ০২ শতাংশ কম। এতদিন এসব হিসাব ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হতো।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক টানাপড়েনে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশগুলোতে। ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে পোশাক কেনা কমিয়েছে ওইসব দেশের নাগরিকরা। এই দেশগুলো বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বড় বাজার হওয়ায় রপ্তানির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, কানাডা ও বেলজিয়াম। এই ৯টি দেশ থেকে বাংলাদেশ আরএমজি থেকে ৬৩৫ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা মোট আরএমজি রপ্তানির ৭১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, তৈরি পোশাকের নিট রপ্তানি (আরএমজি রপ্তানি মূল্য থেকে কাঁচামাল আমদানি মূল্য বিয়োগ করে নির্ধারিত) ছিল ৫০৪ কোটি ডলার বা মোট আরএমজি রপ্তানির ৫৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে যে আয় দেশে এসেছে, এর মধ্যে নিটওয়্যার এগিয়ে আছে। আলোচ্য সময়ে নিটওয়্যার থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৭৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। অপরদিকে, ওভেন থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৪০৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার। গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকার নানা সুবিধা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রি–শিপমেন্ট ক্রেডিট সুবিধা। করোনা–পরবর্তী সময়ে রপ্তানি ঋণ সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। এ তহবিল থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য ঋণ সুবিধাসহ সুদহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হয়েছে, যা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া, তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে রপ্তানির ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তার সুবিধা দেয় সরকার। একই সঙ্গে রয়েছে ২ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো দেশগুলোতে এখন বর্ধিষ্ণু আমদানি ও সেবাদায় নিষ্পন্ন করা এমনকি প্রবাসী আয় কিংবা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনয়ন ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। ঠিক এই সময়ে রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের ক্রমাগত বাণিজ্য ঘাটতি এমনকি চলতি হিসাবের ঘাটতি মোকাবিলায়ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির বিষয়টি কাজে আসবে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, রপ্তানি ঝুড়িতে আমাদের যোগ করতে হবে আরও নতুন নতুন পণ্য। বিশেষ নজর রাখতে হবে ডলারের বিপরীতে দেশি মুদ্রার বিনিময় হারের দিকেও। অধুনা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ডলারের রেট আর আমদানিকারকদের আমদানি দায় নিষ্পন্নের রেট–যা লুকোচুরির মধ্য দিয়ে প্রবাসী বা রপ্তানিকারকদের তেমন লাভ হয়নি। বৈধ বিনিময় ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার কারণে প্রবাসীদের পাঠানোর মতো অর্থের অনেকটাই হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন শুরু হয়েছে। বাজার শৃঙ্খলা মেনে ধীরে ধীরে বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা করা গেলে সব অংশীজনেরই লাভ হয়। এতো নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সমপ্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে।