মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ : প্রসঙ্গ শহীদ আবদুল হামিদ

কানিজ ফাতেমা | মঙ্গলবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপ্রকাশের সংগ্রামের সূচনা হয় এবং তা পূর্ণতা লাভ করে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। বাংলার আপামর জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সশস্ত্র দখলদার বাহিনী পাশবিক শক্তি নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সমগ্র বাংলায় তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠে। শহরেবন্দরে, গ্রামেমহল্লায় গড়ে উঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জনপদ কক্সবাজারের চকরিয়া থানায়ও সেই স্বাধিকার আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে। যুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল। কক্সবাজার ছিল ১নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আবদুল হামিদ। তাঁর নেতৃত্বে চকরিয়ার মুক্তিযোদ্ধারাও পাক হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে চকরিয়া থানা হানাদার বাহিনী মুক্ত করে।

আবদুল হামিদ তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার বৃহত্তর চকরিয়া থানার মাতামুহুরী নদী বিধৌত কাকারা ইউনিয়নের বমু বিলছড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫০ সালের ৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে তিনি ১৯৬৭ সালে এইচএসসিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা মেধাতালিকায় দশম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি একই কলেজে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। আব্দুল হামিদ মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ায় সম্মান চূড়ান্ত পরীক্ষার কয়েকটি কোর্সের পরীক্ষা দিতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গড় নিয়মে ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কলেজে অধ্যয়নের সময়ই আবদুল হামিদ ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮৬৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশ হৃদয়ে ধারণ করে আবদুল হামিদ মুক্তিকামী জনতাকে সংঘটিত করতে চকরিয়ায় এসে এস. কে. শামসুল হুদাকে সভাপতি ও প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরী কমিটি গঠন করেন। ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টায় পাক সেনারা দেশীয় রাজাকারদের সহযোগিতা ও আধুনিক মরণাস্ত্রের বদৌলতে চিরিঙ্গার হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হুদা, দেলোয়ার হোসেন, মোঃ আবদুল ওদুদ, বাবু সারদা কিশোর দাস, আবুল কালাম ও আনোয়ার হোসেন বাঙালিসহ আরো অনেকের বাড়িঘর লুটপাট করে এবং জ্বালিয়ে দেয়। হাবিলদার আবুল কালামের প্রশিক্ষণে আবদুল হামিদ, মাহবুবুর রহমান, জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, নজির আহমদ প্রমুখ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমিত শক্তি নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন উপলব্ধি করলেন, অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আরো প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রয়োজন তাই তারা ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুল হামিদসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ১৮ মে দেশকে শত্রুমুক্ত করার অভিপ্রায়ে ভারতের মিজোরাম প্রদেশের দেমাগ্রীতে পৌঁছেন। টানা ২১ দিন প্রশিক্ষণ শেষে হামিদের নেতৃত্বে ১০ জনকে পাঠানো হয় রাঙামাটিতে। সেখানে তারা হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ভারত থেকে আসার সময় হামিদকে গেরিলা দলের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এ দলে সেকেন্ডইনকমান্ড ছিলেন নজির আহমদ। অন্যান্যদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ ইউনুছ, মাহবুবুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুসা, লামা উপজেলার মুসা (পরবর্তীতে এ মুসাই ষড়যন্ত্র করে হানাদারদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে আবদুল হামিদকে ধরিয়ে দেয়), নুর মোহাম্মদসহ আরো অনেকে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার ফিরেই গেরিলা তৎপরতা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি চকরিয়া থানায় অবস্থিত হানাদার শত্রুঘাঁটিতে বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান চালিয়ে শত্রুদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। এরপর ইপিআর এবং নিজের দল নিয়ে হামিদ বর্তমান বান্দরবান জেলার অন্তর্গত লামা থানা আμমণ করে বিরাট সাফল্য অর্জন করেন। লামা থানা অপারেশনের পর আবদুল হামিদ অন্য আরেকটি গেরিলা গ্রুপের সাথে দেখা করতে আজিজনগর যান। সেখান থেকে ফেরার সময় জঙ্গলি পথে পিছলে পড়ে তার পা মচকে যায়। আহত পা নিয়ে তিনি মায়ের সাথে দেখা করতে বাড়ি যান। উল্লেখ্য হামিদের কাছে আগেই খবর এসেছিল তাঁর মা অসুস্থ।

এদিকে আবদুল হামিদকে আটক করার জন্য নানাবিধ ফাঁদ পাতা হয়। হামিদকে ধরার জন্য তারা এগিয়ে এলে হামিদ অন্ধকারে তার রিভলভারটি না পেয়ে গ্রেনেড চার্জ করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ডিটোনেটর সঠিকভাবে না লাগায় গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়নি। হামিদ তার ভগ্নিপতি আজমল হোছাইন এবং মেজ ভাই তমিজ উদ্দিনসহ ধরা পড়েন। গ্রেফতার করে তাদেরকে লামা থানার দক্ষিণ পাশে চম্পাতলী প্রাইমারি স্কুলে এনে বীভৎস অত্যাচার করা হয়। তাদের উদ্ধারের জন্য হামিদের দলের সেকেন্ডইনকমান্ড নজির আহমদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মাতামুহুরী নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মেজর জামান কক্সবাজারে অবস্থানরত পাকবাহিনীর কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দেয়। সংবাদ পাওয়া মাত্র তাদের ধরে নেয়ার জন্য কক্সবাজার থেকে ২ প্লাটুন পিসি আর্মস ফোর্স লামায় চলে আসে। সংগত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পেতে ব্যর্থ হয়।

আর্মিরা তাদেরকে সুবেদার বেনারসের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাড়ে সীবীচ রেস্টহাউজে বন্দীদের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভীর কাছে হস্তান্তর করে। তাদেরকে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। রাত একটার দিকে আসিফ রিজভী তল্লাশীর উদ্দেশ্যে হামিদের জামার পকেটে হাত দিতে উদ্যত হলেই তিনি গর্জে উঠে বলেন, ‘Stop Don’t you know I am a citizen of Bangladesh, you must seek permission before checking’ ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভী চমকে উঠলেন, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কারণ সামনে বসে থাকা একটি যুবক বয়স বেশি হলে ২২ কি ২৩ হবে যে কিনা এখন তাদের হাতে বন্দী সেই ছেলের কি তেজী কণ্ঠ। এই ক্যাম্পে এর আগেও অনেক মানুষ আনা হয়েছে, রিজভী তাদের নিজের ইচ্ছেমত শাস্তি দিয়েছে কিন্তু কেউ মুখ ফুটে তার মুখের সামনে কথা বলার সাহস পায়নি আর এই ছেলেটি রীতিমত ধমক দিচ্ছে। সেই মানুষগুলোকে দেখলেই মনে হতো এরা মৃত্যু ভয়ে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে আর এই ছেলেটিকে দেখলে মনে হচ্ছে মৃত্যু নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। ক্যাপ্টেন রিজভী হামিদকে জিজ্ঞেস করে

তোমার নাম হামিদ?

হামিদ নয় আবদুল হামিদ।

তোমার সাথে আর কে কে আছে যে হিন্দুস্তানের জন্য কাজ করে?

আমি বাঙালি, দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমি একটি শব্দ উচ্চারণ করবো না। তোমাদের পদানত হতে আমার জন্ম হয়নি। আমি এখন তোমাদের বন্দী, যা খুশি তোমরা করতে পার। আমি কোনো কথা বলবোনা, বলবো না। ফলে তার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পা উপরের দিকে ছাদের রডের সাথে বেঁধে মাথা নিচের দিকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। আরো জিজ্ঞেস করা হতো সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, ঠিকানা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সম্পর্কে। হামিদ নির্বিকার থাকতেন। মুখে শুধু বলতেন, ‘জয় বাংলা, এদেশ স্বাধীন হবেই’। এ নির্ভীক বীরত্বপূর্ণ উচ্চারণ ও আচরণ দেখে ক্যাপ্টেন রিজভীর মতো নরপশুও মন্তব্য করেছিলেন হামিদের মতো ছেলে যে দেশে জন্মায় সে দেশ স্বাধীন না হয়ে পারে না। আবদুল হামিদের বড় ভাই তমিজ উদ্দিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এক সপ্তাহ পর ভগ্নিপতি আজমল হোছাইনকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং হামিদকে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেও তাঁর মুখ থেকে কোনো তথ্য বের করতে না পারায় ১৯ নভেম্বর জবাই করে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে হামিদের লাশ উদ্ধারের জন্য তাঁর স্বজন এবং সহযোদ্ধারা পুরো কক্সবাজার খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। অনেক খোঁজার পর টেকনাফের একটি বধ্যভূমি থেকে অগণিত পচা লাশের মধ্য থেকে খয়েরি পাঞ্জাবির চিহ্ন সমেত হামিদের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। ’৭১ এর ২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের হযরত শাহ উমর (🙂 এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে শহীদ আবদুল হামিদকে সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সমাহিত করা হয়। কাকারা হযরত শাহ উমর (🙂 মাজার প্রাঙ্গনে তাঁর কবরের স্মৃতি ফলকে লেখা রয়েছে ‘যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ শহীদ আবদুল হামিদ’ আইডি নং: ০২১৩০৩০০০৮ (লাল মুক্তিবার্তা)

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের একমাত্র ‘শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস’, কক্সবাজারে ‘শহীদ আবদুল হামিদ পাঠাগার’ চকরিয়া কলেজে ‘শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস’, শিকলঘাটামানিকপুর ও লামাবমু বিলছড়ি সড়কদ্বয় ‘শহীদ আবদুল হামিদ সড়ক’, চকরিয়া শহীদ আবদুল হামিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ আবদুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়, চকরিয়া পৌরসভা কর্তৃক নির্মিত ‘শহীদ আবদুল হামিদ বাস টার্মিনাল’ প্রভৃতি তাঁর স্মৃতি বহন করছে আজও।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধআহ্‌বান
পরবর্তী নিবন্ধশুধু রমজানে নয়, নামাজ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাধ্যতামূলক