চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেছেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগার চট্টগ্রাম। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক স্মরণীয় কীর্তি ও বীরত্ব গাঁথা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে বিশেষ শ্রেণী গোষ্ঠীর কবল থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, জনগণের সম্পদে পরিণত করতে হবে। চট্টগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে গতকাল সকালে নগরীর সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভার পূর্বে ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়।
বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বৈষম্য ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। সর্বস্তরের জনসাধারণ সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সবার স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ বিনির্মাণ করা। কাঙিক্ষত সে স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারিনি বলেই আমাদের মুক্তির পথে অনেক বাধা এসেছে। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আবারও একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও জনগণের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই ২০২৪’র ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানকে সফল করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সভায় সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী, যৌথবাহিনী ও মিত্র বাহিনীসহ সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থাপিত অস্ত্রাগার পাক হানাদার বাহিনীর দখলে নেয়। সে সময়ে সীতাকুণ্ড থেকে ভাটিয়ারী হয়ে ফৌজদারহাট পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনী প্রবলভাবে প্রতিরক্ষা করে রেখেছিল। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যখন যৌথবাহিনী অত্যন্ত প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করে যুদ্ধমুখী অবস্থান নেয় তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পিছু হঁটতে বাধ্য হয়। তারা চলে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম–ঢাকা মহাসড়কের ভাটিয়ারী এলাকায় রাস্তার একটি সেতু ভেঙে দিয়ে যায়। এ জন্য যৌথবাহিনী চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারেনি। তারা ১৬ ডিসেম্বর রাতেই এখানকার খালেই সেতুর পাশে সংযোগ সেতু তৈরি করে। ১৭ ডিসেম্বর ভোর বেলা এরা অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারে। সকাল বেলা ১নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ও যৌথ মিত্র বাহিনীর আনন্দস্বরূপ দু’জনে মিলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এটাই চট্টগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবসের মূল ইতিহাস। এটি কোন জাতীয় দিবস নয়, চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবিতে আনন্দমুখর পরিবেশে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ এন এম ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, দেশ আমার, মহান মুক্তিযুদ্ধও আমাদের সবার। এ স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের গর্বের জায়গা, এটাকে সে জায়গায় রাখা উচিৎ। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা হয়নি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। কোন তারিখে কোন জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে, সেটিও আমরা এখনও করতে পারিনি। এগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে, আলাদা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। এ সব বিষয় নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা যদি মন্ত্রণালয়ে লেখেন, পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেলা ১৭ ডিসেম্বর ও মীরসরাই উপজেলা ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। চট্টগ্রাম জেলা একটি বন্দর এরিয়া হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশেষ নজরসহ একটি টার্গেট ছিল। এটাকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে আমাদের আমদানি–রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পরপর সকালেই পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও খুলনা জেলা হানাদার মুক্ত হয়। এসব বিষয়গুলো জানতে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকে আরও স্পষ্টীকরণ জরুরি।
জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সিফাত বিনতে আরার সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. নোমান হোসেন (উপসচিব) ও জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) এ এন এম ওয়াসিম ফিরোজ।
আলোচক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা কামাল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল বারিক। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি–উর রহমান জাদিদ, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা আলোচনা সভা ও র্যালিতে উপস্থিত ছিলেন।