‘আমরা বিশ্বাস করি ক্যান্সারের চিকিৎসা আছে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার রোগী ভালো হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ এবং সমন্বিত কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। হাজার হাজার ক্যান্সার রোগী চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছেন। অবস্থাপন্নরা বিদেশ যেতে পারলেও হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ক্যান্সারের চিকিৎসা সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য শতকোটি টাকা প্রতি বছর বিদেশ চলে যাচ্ছে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল একটি ক্যান্সার হাসপাতাল এবং রিচার্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এগিয়ে এলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। কোন ভালো কাজের উদ্যোগ কখনো থেমে থাকে না। জনগণের টাকায় এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হবে’। ২রা ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিনিয়র ক্লাবে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের উদ্যোগে চট্টগ্রাম ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিচার্স ইনস্টিটিউট বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন প্রাক সাংবাদিক সম্মেলনে এই বক্তব্য তুলে ধরেন।
ক্যান্সার এই মরণ ব্যাধির চিকিৎসা আমাদের দেশে অপ্রতুল। ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থা সাজানোর প্রত্যয়ে সরকারের সাথে বেসরকারি এই উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করছে। শিশুদের কল্যাণের জন্য ৩১ শে ডিসেম্বর ১৯৭৯ জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শিশু দিবস ঘোষণা করেন। জাতিসংঘের এই উদ্যোগকে কল্যাণরুপ দেওয়ার মানসে ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তি একটি শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ডা. এ এফ এম ইউসুফ ছিলেন চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতালের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮০ সালের ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এই হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে। যা ছিল সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও গরীব শিশুদের বহিঃবিভাগের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান। ডাঃ এস এম ফজলুল করিম ছিলেন হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারী। প্রথম ট্রেজারার ছিলেন জনাব এম আই খান। ‘কোন রোগী যেন অর্থাভাবে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়’ এই মন্ত্রে বলীয়ান এই হাসপাতালটিকে জনগণের হাসপাতাল বলা যায়। তাইতো জনাব এম এ মালেক ক্যান্সার হাসপাতাল ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের প্রাক সংবাদ সম্মেলনে মানুষের সহায়তার কথা বলেছেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই হাসপাতাল মানুষের পাশে ছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই হাসপাতালে শ্রম, মেধা ও সামর্থ্য দিয়ে যাঁদের অনস্বীকার্য অবদান স্মরণ করতে হয় তাঁরা হলেন ডা. এ এফ এম ইউসুফ, ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী, প্রফেসর এ এস এম ফজলুল করিম, কর্ণেল (অব:) ডা. মোঃ মহসিন, প্রফেসর ডাঃ এম নুর-উন নবী, প্রফেসর এল এ কাদেরী, ডা. এম এ মতিন, মর্জিনা করিম, মিসেস ওয়াসিফা আহমেদ রুস্তম, কামরুন নাহার জাফর, নুরী আরা সাফা, ফাহমিদা আমিন, এম এ মালেক, কহিনুর নবী, মোস্তফা এ হোসাইন, ডা. মোঃ শহীদ উল্লাহ, ডা. আঞ্জুমান- আরা ইসলাম, ডা. দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, ডা. এম বি জামান, ডা. এ জি চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ আলী, ডাঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রফেসর ডাঃ গোফরানুল হক, ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী, এস এম মোর্শেদ হোসেন, নুর মোহাম্মদ, রেজাউল করিম আজাদ, ডা. সালাম, ডা. নুরুল আমিন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মরহুম ডা. মোস্তাফিজুর রহমান, তাহের ফাউন্ডেশনের মরহুম তাহের ও শেরিনা তাহের, ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, ডা. আবুল বাশার চৌধুরী, ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ প্রমুখ। ২০০৬ সাল থেকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এর কার্যক্রম শুরু হয়। এই হাসপাতালের অধীন সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন মাননীয় ভূমি প্রতিমন্ত্রী জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষে হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত জমির দলিল আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান ও রেজাউল করিম আজাদকে সদস্য সচিব করে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’ উক্ত ক্যান্সার হাসপাতালের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করছেন। ১০০ শয্যার হাসপাতালটি নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা, দশতলা হাসপাতালটি হবে ৫৫ হাজার বর্গফুটের। আনবিক শক্তি কমিশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে সীমিত পরিসরে বর্তমানে হাসপাতালটিতে ক্যান্সার চিকিৎসা চলছে প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৩০ জন, আন্তর্বিভাগে ১০ জন এবং ১০জন ক্যামোথেরাপি নিচ্ছে বলে জানা যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ইং সালে বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল চত্বরে এই মানবিক হাসপাতালটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ভূমি মন্ত্রী জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনকালে মন্ত্রী আশাবাদী হয়ে বলেন ‘ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে যারা সহযোগিতা করেছেন তারা অনেক ভালো কাজ করেছেন। অনেকে সন্দিহান ছিলেন মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি ক্যান্সার হাসপাতাল করতে পারবেন? আমি কিন্তু আশাবাদী ছিলাম। তবে উনাদের হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা যারা চট্টগ্রামবাসী আছি তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এই মহৎ কাজটিকে আমাদের মুক্ত হস্তে সহযোগিতা করতে হবে। ক্যান্সার এমন রোগ যার চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। এই চিকিৎসা খুব কষ্টসাধ্য। এই জন্য চট্টগ্রামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা খুবই প্রয়োজন ছিল’। চট্টগ্রামবাসী এগিয়ে এসেছে। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিনই ভূমিমন্ত্রী ০৫ কোটি টাকা, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ও হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এম এ মালেক ১ কোটি টাকা, হাসপাতালের দাতা সদস্য এস এম আবু তৈয়ব ১০ লক্ষ টাকা, ও এন আর বি গ্লোবাল ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন। হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ম রেজাউল করিম আজাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘তিন বছরের মধ্যে আমরা হাসপাতালটি চালু করতে চাই’। হাসপাতালটির ৬বারের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারী ডাঃ আনজুমান আরা ইসলাম বলেন, ‘সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতা নিয়ে কাজ করলে একটি টিম তৈরী হয়। সেই টিম জয়ী হয়। যার উদাহরণ চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। হাসপাতালের রেডিওলজি, প্যাথলজি সহ অনেক বিভাগ ও ভবন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অবদানের স্বাক্ষর’। তিনিও বলেন, এটি মানুষের হাসপাতাল। তথ্য নিয়ে জানা গেছে করোনা কালে জরুরি সভা ডেকে প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে ১ কোটি টাকা অবমুক্ত করে করোনা রোগীদের সেবা প্রদান করা হয়েছে। একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে এই হাসপাতালকে নিয়ে আমার একটি ভালো লাগার বিষয় না লিখলে এই লেখা পূর্ণতা পাবে বলে ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি। এই হাসাপাতালের প্রথম প্রকাশনা ‘সৌরভ’ যা একটি শিশুসাহিত্য সংকলন। এই সংকলের দায়িত্ব পালন করেন মিসেস ফাহমিদা আমিন। ১৯৮৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়। আমার লেখার শিরোনাম মানুষের জন্য ক্যান্সার হাসপাতাল। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল জনগণের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত একটি বেসরকারি হাসপাতাল। এর সাথে সরকারের সম্পৃক্ততা খুবই প্রয়োজন, যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অনুদান ৩৫০ কোটি হলেও চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা মিলে পায় ১০ কোটি টাকা যা অত্যন্ত অপ্রতুল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টির দিকে সুনজর দিলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম চিকিৎসা সেবায় আরো বিকশিত হবে বলে মনে করি। সাথে ছিল, আছে, থাকবে মানুষ, থাকবে আজাদীর মত মিডিয়া। লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক