কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

মির্জার বক্তব্য, বাস্তবতা ও প্রতিকারের উপায়
গত কিছুদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে আছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই আবদুল কাদের মির্জা। প্রথমদিকে আমি তাঁর কোনো বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে পড়িনি এবং দেখিনি। সামান্য যা দেখেছি (টিভিতে) বা পত্রিকায় পড়েছি তাতে মির্জা সাহেবকে আমার স্বাভাবিক ও পুরোপুরি সুস্থ বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিলো কোনো কারণে তিনি বেজায় ক্ষেপে গিয়ে বেখেয়ালি কথাবার্তা বলছেন।
তবে রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করে তিনি যেসব কথা বলেছেন তার কিছু কিছু অংশ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আমার মনে হয়েছে তা সব কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কিছু কিছু অভিযোগ নিয়ে ভাবা দরকার। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পারেন। কারণ মির্জার কণ্ঠে দুর্নীতি নিয়ে আমি অনেক সাধারণ মানুষ ও আমলা-পুলিশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই তিনি সরকারি কর্মকর্তারা লুটপাট করছে দাবি করে বলেন, কিছু কর্মকর্তা মনে করেন আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতায় এনেছেন। এ জন্য তারা যা ইচ্ছা তা করছেন।
আমি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো তুলে ধরছি যেসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কাদের মির্জা বলেন, ‘সরকারি কিছু কর্মকর্তা মনে করে তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনেছে। যা ইচ্ছা তা করছে। লুটপাট করে খাচ্ছে দেশকে। এটা শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ পারবে না। দুর্নীতি শেখ হাসিনাকে বন্ধ করতে হবে। শেখ হাসিনাকে ভোটের রাজনীতিতে একটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এদেশের প্রতিটি মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর এনামুল হক শামীমের সমালোচনা করে কাদের মির্জা বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটা টেন্ডার হয়েছে। সেই টেন্ডারটা উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের নির্দেশে এবং নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরী এবং সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান জেহানের নিয়ন্ত্রণে ফেনীর লিফটন এই কাজ কিনে নিয়েছে। আমি বাধা দিয়েছি, বলেছি পুনঃটেন্ডার দিতে। তারা অন্যদের সিডিউল ফেলতে দেয় না। প্রত্যেকটা বিভাগে এটা চলছে। এখনো করে যাচ্ছে। লিফটন আমাকে বলে আপনার সাথে কথা আছে। টাকার লেনদেন করতে চায়। আমি কি টাকার রাজনীতি করি। এই প্রসঙ্গে কাদের মির্জা আরও বলেন, ‘এনামুল হক শামীম কেন আমাকে কল করে নেগোশিয়েশন করতে বলল? এতে কি বোঝা যায়? তারা আমাকে টাকা দিতে চায়? এ দেশের মানুষ জানে এনামুল হক শামীম কি করেন। কত হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’
নোয়াখালীতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কাদের মির্জা। তিনি বলেন, নোয়াখালীতে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছে। যারা কাজ পেয়েছে তাদের রিমান্ডে আনেন। কত কোটি টাকা তাদের কাছ থেকে নিয়েছে? একটা কাজেরও মান নাই। তিনি আরও বলেন, আজকে কাজ করা হয়, কাজের কোনো মান নাই। ছয় মাস আগে কাজ করা হয় তিন মাস পরে একই অবস্থায় ফিরে যায়। কাজের মান নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মমাফিক টেন্ডার করতে বলেছি। সকল প্রকৌশলী বলেছেন, বিষয়টা তারা দেখবেন। কেবল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। চারদিন হলো তিনি কথা বলেননি। সেই নির্বাহী প্রকৌশলী এখনও বহাল আছেন। নোয়াখালীতে চাকরি বাণিজ্য প্রসঙ্গে কাদের মির্জা বলেন, একটা গরিবকে পুলিশে চাকরি দিয়ে একরাম চৌধুরী পাঁচ লাখ টাকা নেন। গরিব প্রাইমারি স্কুলের পিয়নকে চাকরি দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা নেন। প্রশাসনকে তারা নানাভাবে ব্যবহার করে এই কাজগুলো করছে।
তিনি বলেন, নোয়াখালীতে সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ সচিব) দিচ্ছে ১০ জন। এই নিয়োগে একরাম চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত ও সোহেল বাণিজ্য করেছে। এখনো সেখানে চাকরি বাণিজ্য চলছে। একরাম চৌধুরীর অস্ত্রে ২৪টি মায়ের বুক খালি হয়েছে বলেও দাবি করেন মির্জা কাদের। এই অভিযোগ বিরোধীদলীয় কোনো নেতার নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাইয়ের যিনি নিজেও আওয়ামী লীগের টিকেটে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মির্জা অনেকটা অস্বাভাবিকভাবে কথা বললেও দলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর আস্থাশীল ও অনুগত। শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সঠিক নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ আজ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়মেরও বিস্তার ঘটেছে। দেশে প্রচলিত দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে হাটে-মাঠে ঘাটে, চায়ের দোকানে বা আলোচনার টেবিলে যে অভিযোগগুলো আলোচিত হয় এবং যে ভাষায় হয় তা হবহু মির্জার বক্তব্যে উঠে এসেছে। কাজেই মির্জার কথাগুলো অর্থাৎ অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা দরকার। শুধু তাই নয় তার প্রতিকারেরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার। মির্জা ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই বলে এত কথা এতদিন ধরে বলে আসতে পারছেন অন্য কেউ হলে পারতেন বলে মনে হয় না। সরকার, মন্ত্রী ও দলের জন্য অস্বস্তিকর হলেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের শক্ত ভিত হলো দল। মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ তৃণমূলে দল সংগঠিত না থাকলে সরকারের ভিতও শক্ত হয় না। এরজন্য প্রয়োজন দলের কার্যক্রম গতিশীল করা। দলে গণতন্ত্রের চর্চা করা। সৎ, মেধাবী, নিবেদিত নেতাকর্মীদের সঠিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করা। দল যখন এমপিদের বৈঠকখানা থেকে পরিচালিত হয় তখন আর তার প্রাণশক্তি থাকে না। দল পরিচালিত হবে নির্বাচিত নেতাদের দ্বারা। একজন এমপি আইনসভার সদস্য। তাঁর কাজ আইন প্রণয়ন করা। এলাকার রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত কমিটির মাধ্যমে। একজন মন্ত্রী বা এমপির স্থানীয়ভাবে দলকে নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক নয়। মির্জার অভিযোগ মনগড়া নয়। দিনদিন সরকার আমলা ও পুলিশনির্ভর হয়ে উঠছে। উপেক্ষিত হচ্ছে দলের লোক। এতে দলের সর্বস্তরে হতাশাও বিরাজ করছে। অনেক সময় মনে হয় আমলা আর পুলিশ মিলে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। এটি এখন গোপনও থাকছে না। বিভিন্ন সময় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কারো কারো আচার-আচরণে তা প্রকাশও পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের লোকের চেয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই লজ্জা পান। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যখন দলীয় লোকদের মতো আচরণ করেন তখন তা সরকারের জন্য স্বস্তিকর নয়, মঙ্গলজনকও নয়।
আমরা দুর্নীতির জন্য সাধারণত রাজনৈতিক নেতাদেরই দায়ী করে থাকি। কিন্তু দুর্নীতি শুধু রাজনৈতিক নেতারাই করেন না। বরং ব্যাপক দুর্নীতি করে থাকেন সরকারি কর্মচারীরাই। এরা সব সরকারের আমলেই তা করে থাকেন। বন্দুকটা রাখেন রাজনীতিবিদদের কাঁধে। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে যা উপার্জন করেন তার বিশাল একটি অংশ আবার দলের নেতা-কর্মীদের পেছনে ব্যয় করেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সকল আয় তার পরিবারের লোক ছাড়া আর কেউ ভাগ পায় না। দেশের অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাড়ি ও শপিংমলে দোকানের মালিক কারা তার একটি পরিসংখ্যান নেওয়া গেলে আমার অভিযোগের সত্যতা মিলবে। এদের মধ্যে অনেকে মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিদেশের বেগমপাড়ায় এদের সংখ্যাই বেশি।
এই পরিস্থিতি বিরাজমান বেশ আগে থেকেই। তবে মির্জা কাদের এই সময়ে কেন সোচ্চার হলেন তা বুঝতে অক্ষম হলেও অন্তত এটা বুঝতে পারছি যে, অনেকের মনে ক্ষোভ দানা বেধে আছে। দুয়েকজন প্রকাশ করলেও অধিকাংশ চুপ করে আছেন। বিপদ হলো সেখানে। মৌনতা সবসময় সম্মতির লক্ষণ নয়, ফেটে পড়ার পূর্বলক্ষণও হতে পারে। আমার ব্যক্তিগত শঙ্কা শেখ হাসিনাকে নিয়ে কারণ এই একজন মানুষ যাঁর স্বপ্ন ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশটা এই অবস্থানে এসে দাঁড়াল তাঁকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে কিছু লোভী ও দুর্বৃত্ত। কাজেই মির্জার বক্তব্য পাগলের প্রলাপ বলে উপেক্ষা না করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকারের উপায় বের করাই হবে বিচক্ষণতা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের জন্য ক্যান্সার হাসপাতাল
পরবর্তী নিবন্ধসমন্বয় ও উন্নয়ন : মেয়রের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স