সেই ছোট বেলার ছাত্র জীবন থেকে শুনে আসছি ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। যে দেশ যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ তত বেশি উন্নত। একটা জাতিকে সুশিক্ষায় পরিচালিত করার নেপথ্যের কারিগর হলো শিক্ষক বা জ্ঞান দাতা। একটা ছাত্র তার শিক্ষাদান, তার চরিত্রগঠনে, উচ্চ শিক্ষা লাভে একজন শিক্ষকের অবদান অনেক বেশি। পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষকের মর্যাদা সর্বাগ্রে। যিনি শিক্ষক প্রাইমারী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁকে দেখলে একটু হলেও মাথা নোয়াতে ইচ্ছে হয়। তিনি অনেক শ্রদ্ধার পাত্র। শিক্ষকের ত্যাগ, সমাজে তাঁর সম্মান এবং তার পরিশ্রমকে মূল্যায়ন স্বরূপ ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বৎসর ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বশিক্ষা দিবস পালন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যদি দেশকে সোনার বাংলা বানাতে হয় তবে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার হার বাড়লে দেশ উন্নত হবে। আর এই শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য তিনি শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ান, তাদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আজ তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষদের বেতন ভাতা বাড়িয়েছেন এবং হাজার হাজার শিক্ষক চাকরীতে নিয়োগ দিচ্ছেন। আমরা হয়ত ভুলে গেছি ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্যান সর্বত্র পূজ্যতে’। শিক্ষকদের মর্যাদার উদাহরণ স্বরূপ- দিল্লির এক বাদশা তার ছেলেকে প্রশ্ন করলেন কেন সে শিক্ষক মৌলভী সাহেবের পা নিজ হাতে ধুয়ে দেয়নি। ১৯৯৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমান সফরে গিয়েছিলেন। ওমানের বাদশা নিজে প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা সহকারে আনতে বিমান বন্দরে যান। বাদশা নিজে বিমানে উঠে প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং সঙ্গে করে বিমান থেকে নেমে তাঁর গাড়িতে উঠালেন। কিছুদূর গিয়ে বাদশা ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়ে নিজে গাড়ি চালাতে লাগলেন। তিনি কিন্তু দুইবার প্রটোকল ভঙ্গ করলেন।
পরে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন ‘আমি যখন ভারতে পুনেতে পড়েছিলাম উনি আমার শিক্ষক ছিলেন’। শিক্ষকদের জাতির বিবেক বলা হয়। জাপানে স্কুলে ছাত্রদের টানা চার বছর নীতি-নৈতিকতার ওপর পড়ানো হয়। কিন্তু হালে বাংলাদেশে শিক্ষকদের এ অবস্থা কেন? জাতি আজ খুবই চিন্তামগ্ন এবং ভীতসন্ত্রস্ত। প্রশ্ন জাগে সমাজ কি অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল? অচিরেই এটার একটা বিহিত হওয়া উচিৎ। মানুষ হিসাবে যদি মানবতাবোধ থাকে তবে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবার জন্য একই চিন্তা করা উচিৎ। হিংসা, বিদ্বেস, সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে পড়ে যে সমস্ত শিক্ষক আজ প্রাণ হারাচ্ছে বা পঙ্গুত্ব বরণ করছে, সামাজিক ভাবে অপদস্থ ও অপমানিত হচ্ছে তারা তাদের শতভাগ হারাচ্ছে। বিবেকবান লোকদের তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিৎ। আজকে আমার মান সম্মান মর্যাদা ধুলোই মিশে গেল কালকে আপনারই একই অবস্থা হবে। ভুলে যাবেন না এটা বর্তমান সমাজের জন্য অশনি সংকেত। প্রশাসন এ ব্যাপারে আরও কঠোর হয়ে তড়িৎ গতিতে অপরাধের বিচার করা উচিত। বহুবার পত্র পত্রিকায় এর ভয়াভয়তা সম্মন্ধে দেশবাসিকে সতর্ক করা হয়েছে। সরকারও যথেষ্ট দৃষ্টি রাখছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বরঞ্চ দিন দিন এর প্রকোপ বাড়ছে। কারণ এই অপরাধ প্রবণতা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। একমাত্র পিতা, মাতা, পরিবার, লোকালয়ের সচেতন ব্যক্তিরা পারে এই অবক্ষয়ের সম্প্রসারণ রুখতে। এর আর একটা প্রধান কারণ যুগের পরিবর্তন, আধুনিক ইলেট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেটা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা দুনিয়াকে জানার আগে তাদের হাতে পৌছে গেছে। এখন একটা কিশোর বয়সের ছেলের সাথে কথা বলতেও ভয় হয়। এই বয়সী ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোন অপব্যবহারের ফলে অপরিণত বয়সে যৌন উদ্দীপনা জেগে উঠে। তখন অপরাধে লিপ্ত হয়। এখন প্রাইমারি স্কুল থেকে হাই স্কুলে পর্যন্ত রাজনীতি, দলবাজি ঢুকে গেছে। যেটা আমরা কখনো কল্পনা করিনি। এই সমস্ত অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতাদের আরও বেশি সাবধান হয়ে যাওয়া উচিৎ। নতুবা এগুলো ঘটতে থাকবে। বুঝতে হবে একদিন তাদেরও এর পরিনতি ভোগ করতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়। কত বীভৎস, কত আতঙ্কের, কত মর্মান্তিক। পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি সারাদেশের সচেতন ও অসাম্প্রদায়িক মানুষদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এগুলো একেবারে নতুন নয় বরং বেশ কিছুদিন থেকে নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং হিসাব করলে প্রতিয়মান হয় সনাতন ধর্মের শিক্ষকদের উপর এই ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। দেশে বিবেকবান লোকের সংখ্যা কম নয়-যখন জানলো সরকারি প্রশাসনের লোকের সামনে একজন অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পাড়ানো হয়েছে তখন বিবেকবান মানুষ লজ্জায় ও অপমানে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। সমস্ত জাতি আজ ভীষণভাবে অনুতপ্ত। এর পর পরই ঘটে গেল আরও হৃদয় বিদারক ঘটনা। একজন স্বনামধন্য শিক্ষককে তারই স্কুলের ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললো। ২০১৬ সালে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে এক সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে উঠ-বস করানো হলো। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ও আমোদিনী পালকে হেনস্থা করার ঘটনা সবার জানে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক শিক্ষিকাকে হেনস্তা করলো একই বিভাগের এক শিক্ষার্থী। এই রকম আরও অনেক ঘটনা পর পর ঘটে যাচ্ছে কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। টক-শো আর মানব বন্ধন হবে এবং এক সময় সব বিস্মৃত হয়ে যাবে। আমাদের বা আমাদের পরবর্তী সময়ে সেই বৃটিশ আমল থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সনাতন ধর্মের শিক্ষকের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন সেটা কমে আসছে। এই রকম ঘটনা ঘটলে আরও কমতে থাকবে। শিক্ষকরা স্কুলে যেতে ভয় পাবে। ছাত্র-শিক্ষকদের যে মধুর সম্পর্ক সেটা আরও বিনষ্ট হবে। আন্তরিকতার অভাব ঘটবে। ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এ.পি.জে আবদুল কালাম বলেছেন ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু শিক্ষকেরা চায়না তার ছেলেমেয়ে শিক্ষক হোক। স্কুল জীবনের অনেক কথা মনে পড়ে-হেডমাস্টার রুম থেকে বের হলে বারন্দার সব ছেলেমেয়েরা হুড়োহুড়ি করে ক্লাসে ঢুকে যেত। গরীবের ছেলে তার মাত্র একটা শার্ট, শিক্ষক বলতেন -তুমি স্কুল থেকে গিয়ে সেটা ধুয়ে দিবে রাত্রে শুকিয়ে যাবে- স্ত্রি করতে হবে না। সেটা ছেড়া হলেও পরিষ্কার দেখাবে। মিথ্যা বলা একদম বরদাস্ত করতেন না। ছুটির ঘণ্টা বাজলে কি দৌঁড়, মাঠে কি ছুটাছুটি। এখনত মাঠও নেই। এখন এগুলো বাদ দিয়ে কিছু ছেলেরা কিশোর গ্যাং করে – যে গ্যাং এমন কোনো অপরাধ নেই করে না। যে শিক্ষক পিতৃতুল্য জীবনের আলো দেখায় সেই শিক্ষদের আজ কী দুরবস্থা। ছাত্রদের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। নিগৃহীত হতে হচ্ছে। ছাত্ররা যতই বিদ্যান হোক, উচ্চপদে থাকুক, আদর্শবাদী ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে মাথা নত করবেই। রাস্তায় বা অনুষ্ঠানে দেখলেই ছাত্র পা ধরে সালাম বা প্রণাম করতেই শিক্ষক জিজ্ঞাসা করবে তুমি কে বাবা? ছাত্র বলে স্যার আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। শিক্ষক হাসি দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললো ভালো থেকো। শিক্ষক মনে মনে বললো আজ আমার জীবন সার্থক। অথচ সেই শিক্ষকরা এখন ছাত্রদের শাসন করতে ভয় পায়। আমরা যারা প্রবীন নিজেকে প্রশ্ন করি কেন এমন হলো? ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা ভেবে খুব চিন্তা হয়। এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। সামাজিক এবং সরকারি ভাবে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মানুষ হিসাবে খুবই অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। সরকারকে শিক্ষক সুরক্ষার কথা বিশেষ ভাবে ভাবতে হবে। আশাকরি ছাত্র-শিক্ষদের মধুর সম্পর্ক আবার গড়ে উঠুক। সমাজ কলুষ মুক্ত হোক।
লেখক : প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল,চট্টগ্রাম।