মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি : ডলার পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ১৪ জুলাই, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

গত কয়েক মাস ধরে দেশে হঠাৎ ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর অর্থ হলো, হয় ডলারের সরবরাহ কমে গেছে অথবা ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এটা যে শুধু ডলারের ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কিন্তু কেন এমন হলো?
২০২০ সালের শুরু থেকে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি বিপাকে পড়ে। ২০২২ সালের প্রথম দিকে সংক্রমণ কমতে শুরু করলে শুরু হয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পালা। তবে কোভিড ১৯ চলাকালীন সময়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় ভাটা ও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ঐ সময়ে জাহাজে মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকসানের ফলে অনেক জাহাজ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে অর্থনৈতিক সংকট আরে ঘনীভূত হয়। কারণ প্রাকৃতিক গ্যাস, গম ও তেলের জন্য রাশিয়ার উপর বিশ্বের অনেক দেশ বিশেষ করে ইউরোপ নিভর্রশীল। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের গম, তেল ও গ্যাসের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অন্য দিকে চীন শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করায় সামান্য কোভিড দেখা দিলেই কঠোর লকডাউনের নীতি গ্রহণ করে। ফলে তারাও বিশ্ব বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ে। তবে সবকিছু সামলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতিতে ভালো অবস্থানে আছে। তারা কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি ভালোভাবে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ তাদেরকে তেমন একটা স্পর্শ করতে পারে নি এবং এটা তাদের জন্য শাপেবর হয়েছে। তবে কোভিডের কারণে তাদেরও মূদ্রাস্ফীতি বেড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো। তবে সর্বাত্মক চেষ্টায় তারা সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। একসময় তাদের মূল্যস্ফীতি ৮% ছাড়িয়ে যায়। যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই অবস্থায় দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক(জেরোমি পাওয়েল) মে ২০২২ এর শুরুতে সুদের হার আধা শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে মার্কিন অর্থনীতি আবারো চাংগা হয়ে উঠে।বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতি বিশ্বে একমাত্র স্থিতিশীল অর্থনীতি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় রাশিয়া, ইউরোপ ও চীন নিস্ক্রিয়তা, মন্দা ও নিষেধাজ্ঞায় বিধ্বস্ত। ফলে বিনিয়োগের একমাত্র স্থান হলো যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অবাধে ডলার ঢুকছে ও বিনিয়োগ বাড়ছে বন্ড ও শেয়ার ব্যবসায়। অন্যদিকে বর্তমানে সবদিক বিবেচনায় মূদ্রা হিসাবে বিশ্ববাণিজ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে ডলার। ফলে গত ২০ বছরের মধ্যে এখন ডলারের মূল্য সবচেয়ে বেশি।অন্যদিকে ডলার বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের আমদানি মূল্য কম পড়ছে। দ্য ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, এরই মধ্যে ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েনের দাম কমেছে ১১.৭%, ব্রিটিশ পাউন্ড ও ইউরোর দাম কমেছে ৭.৫%, সুইস ফ্রাঙ্ক’র দাম কমেছে ৬.৬% ও চীনের মূদ্রা ইউয়ানের দাম কমেছে ৩.৫%। তবে যেসব দেশ জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য রপ্তানি করে তাদের অবস্থান ভালো আর আমদানি নির্ভর দেশগুলোর অবস্থা খারাপ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে সুদের হার বাড়ায় নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য ডলার ঢুকছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এর প্রভাবে সব দেশ নিজের মূদ্রার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ দৈনন্দিন বিনিময় হার ঠিক করার জন্য আন্তর্জাতিক কোনো একটি মূদ্রাকে মধ্যবর্তী মূদ্রা হিসাবে ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে মধ্যবর্তী মূদ্রা ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী মূদ্রা ছিলো ব্রিটিশ পাউন্ড। স্বাধীনতার পর পাউন্ডের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ১৩.৪৩ টাকা/পাউন্ড। পরে ভারতের মূদ্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ১৮.৯৬৭৭ টাকা/পাউন্ড। তবে ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে তেল সংকট দেখা দিলে বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, বেড়ে যায় আমদানি মূল্য। এতে টাকার মান কমে যায়। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালে টাকার বড় রকমের (৫৮%) অবমূল্যায়ন করে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ৩০টাকা/পাউন্ড। পরবর্তীতে মার্কিন ডলার, পাউন্ড থেকে শক্তিশালী হতে থাকায় ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মধ্যবর্তী মূদ্রা হিসাবে বেছে নেয় মার্কিন ডলারকে। এরপর ১৯৯৩ সালের ১৭ জুলাই বাংলাদেশি মুদ্রা টাকাকে চলতি হিসাবে রূপান্তরযোগ্য করা হয় এবং ২০০৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়। ফলে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ঠিক হয় মূদ্রার বিনিময় হার। তবে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেই আছে। বর্তমানে টাকার বিনিময় হার ৯২.৯৫টাকা/ডলার (যদিও কার্ব মার্কেটে বিনিময় হার ১০০ টাকার মত)। অথচ ১৯৭২ সালে ছিলো ৭.৮৭৬৩ টাকা/ডলার ও ২০০৪ সালে ছিলো ৫৮.৬৯ টাকা/ডলার। অর্থাৎ দিনকে দিন ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে টাকার মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
কোভিড পরবর্তী ও রশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, ভোগ্যপণ্য, তেল ও কাঁচামালের দাম এবং জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ২১-২২ সালে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৬.৬৮%।(যাতে শিল্পের কাঁচামালের আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হলো ৫৪%।তবে সবচেয়ে বেশী খরচ বেড়েছে জ্বালানি আমদানিতে-নয় মাসে প্রবৃদ্ধি ৮৭%)।যদিও রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৫.১৪% তবে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬.২%। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২,২৩০ কোটি ডলার এবং চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি ১,৪০৭ কোটি ডলার। এর চাপ গিয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর। এখন প্রতিমাসে ডলারের ঘাটতি তৈরী হচ্ছে। এই কারণে আমদানি খরচ মিটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে জোগান দিতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ আছে ৪,১০০ কোটি মার্কিন ডলার (২০২১-২২) যা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো সম্ভব। যদিও ২০২০-২১ অর্থ বছরে রিজার্ভ ছিল ৪,৬৩৯ কোটি মার্কিন ডলার। তবে দেশে ডলারের চাহিদা ও যোগানের অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার আরো কারণ আছে। এর মধ্যে কোভিড ১৯ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসায় দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ বেড়েছে এবং হজ্জ মৌসুম আসায় লাখ লাখ মানুষ হজ্জে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডলার পাচারের পরিমানও বেড়ে যাওয়ায় মার্কেটে ডলারের চাহিদা অত্যধিক বেড়েছে। বর্তমানে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় ১০০ টাকা। এরই মধ্যে সুইস ব্যাংকের এক তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে ওখানে বাংলাদেশ মানুষের জমা বেড়েছে ৫৫%। টাকার অংকে যা ২,৯২৮ কোটি টাকা। যার বেশির ভাগই পাচার হওয়া ডলার। এ ছাড়া বিত্তবানরা (সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপী ও রাজনীতিবিদ) সন্তানদের বিভিন্ন দেশে লেখাপড়ার খরচ বাবদ কোটি কোটি টাকা পাঠায়। আবার অনেকে দেশে ব্যবসা, চাকুরী বা অন্য কিছু করলেও পরিবার রাখছেন ভিন্ন কোনো দেশে। যেখানে প্রতিনিয়ত দৈনন্দিন খরচের জন্য ডলার পাঠাতে হয়। এগুলোও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দেশের কিছু মানুষ যেভাবে টাকা পাচার করে বিদেশে বিত্ত বৈভব করছেন তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের কোনো দেশপ্রেম নেই। অথচ এই আমরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমের চরম পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। যদি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর কিছু লোকের দেশপ্রেমে এই রকম ঘাটতি হবে বুঝতেন, তবে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতেন কিনা সন্দেহ।
বর্তমানে বাংলাদেশে চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। কিছুটা রপ্তানী প্রবৃদ্ধি হলেও বেড়েছে আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয়। ফলে সামগ্রিকভাবে ডলারে টান পড়ছে। আর এতেই কমছে টাকার মান। মূলত সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি হলেই একটি দেশ মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে থাকে। বাংলাদেশেরও এই অবস্থা হওয়ায় দফায় দফায় মুদ্রা অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। আর এতে করে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ওভার ইনভয়েসিংসহ বাইরে ডলার পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূলুণ্ঠিত শিক্ষকের মর্যাদা
পরবর্তী নিবন্ধগাউসে জমান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌