মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুক্তি, মতভেদ ও মত বিনিময়ের এক অনন্য প্রক্রিয়া হিসেবে বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সমাজের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতিতে বিতর্কের একটি আলাদা অবস্থান রয়েছে। বর্তমান যুগে শুধু তথ্য জানা বা মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফল করাই যথেষ্ট নয়; বরং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি এবং বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে তোলা অপরিহার্য। বিতর্ক ঠিক এই কাজটিই করে থাকে। এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ গড়ে তোলে, যেখানে প্রশ্ন করার, যুক্তি খণ্ডন করার এবং সৃজনশীলভাবে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
বিতর্কের তাৎপর্য: বিতর্ক বলতে বোঝানো হয় একটি কাঠামোবদ্ধ যুক্তিভিত্তিক আলোচনা, যেখানে দুই বা ততোধিক পক্ষ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের মতামত পক্ষে ও বিপক্ষে উপস্থাপন করে। এটি সাধারণত নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। বিতর্ক এমন একটি চর্চা যেখানে শুধু নিজস্ব অবস্থান উপস্থাপন করাই যথেষ্ট নয়, বরং বিপরীত পক্ষের যুক্তি মনোযোগ সহকারে শোনা ও তা খণ্ডনের জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় একজন বিতার্কিক যেমন নিজের মত স্পষ্ট করতে শেখে, তেমনি অন্যের মতকেও সম্মান করার অভ্যাস গড়ে তোলে।
সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা হচ্ছে এমন এক মানসিক প্রক্রিয়া যেখানে আমরা কোনো বিষয়কে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে তা যাচাই–বাছাই করি, সংশয় প্রকাশ করি এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বিতর্ক এই দক্ষতার উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকর। কারণ:
১. যুক্তির চর্চা: বিতর্কে অংশগ্রহণকারীকে একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে হয়, তথ্য সংগ্রহ করতে হয় এবং তারপর তা বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় যুক্তির ধার ও গভীরতা বাড়ে।
২.প্রশ্ন করার ক্ষমতা: বিতর্ক একজন শিক্ষার্থীকে শেখায় কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে একপেশে তথ্য বা ধারণার বিরোধিতা করতে হয়। এতে ব্যক্তি চিন্তাশীল ও অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে।
৩. বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি: বিতর্কে অংশগ্রহণকারী প্রতিপক্ষের যুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখতে শেখে যে কোথায় দুর্বলতা আছে, কোন তথ্য প্রাসঙ্গিক নয়, ফলে তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা উন্নত হয়।
৪. পক্ষ ও বিপক্ষ চিন্তার ভারসাম্য: বিতর্কে কোনো একটি বিষয়ে দুই দিক থেকেই চিন্তা করতে হয়, এতে করে একতরফা চিন্তার প্রবণতা কমে যায় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
সৃজনশীলতা কেবল চিত্রাঙ্কন বা কবিতা লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হলো নতুন ও কার্যকর ধারণা গঠন, সমস্যার অভিনব সমাধান খোঁজা এবং প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু ভাবার সক্ষমতা। বিতর্ক এই সৃজনশীল চিন্তাভাবনার একটি প্ল্যাটফর্ম।
১. বিকল্প চিন্তার অনুশীলন: বিতার্কিকদের অনেক সময় প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যার সমাধান বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হয়। এটি তাদের চিন্তাকে উদ্ভাবনী করে তোলে।
২. তথ্য সংযোজন ও উপস্থাপনার বৈচিত্র্য: বিতর্কে শুধু তথ্য প্রদান নয়, সেই তথ্য কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। শব্দচয়ন, ভাষার ভঙ্গি, রূপক ও উদাহরণ ব্যবহার সবই সৃজনশীলতার প্রকাশ।
৩. তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: বিতর্ক চলাকালে অনেক সময় আগে থেকে প্রস্তুত না থাকা বিষয়েও কথা বলতে হয়। এই তাৎক্ষণিক চিন্তা ও প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সৃজনশীলতার বাস্তব অনুশীলন ঘটে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বিতর্কের গুরুত্ব: বিতর্ক শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উপাদান। এটি কেবল শিক্ষার্থীর বুদ্ধিভিত্তিক উৎকর্ষ সাধনেই নয়, বরং তার ব্যক্তিত্ব গঠনে, নৈতিকতা চর্চায় এবং নেতৃত্ব গুণ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে বিতর্ক ক্লাব শিক্ষার্থীদের মঞ্চে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান সমপ্রসারণ ঘটে কারণ বিতর্কে অংশ নিতে হলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। বিতর্ক একজনকে শেখায় কীভাবে নিজের যুক্তি শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। দলগত বিতর্কে নেতৃত্ব দেওয়া, মতবিনিময় করা এবং সম্মিলিতভাবে কৌশল নির্ধারণ করা সবই বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে।
শিক্ষাজীবনে বিতর্ক কেবল একটি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম নয়, বরং এটি শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও সামাজিকভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। একজন দক্ষ বক্তা, যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ, সহনশীল শ্রোতা এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে বিতর্কের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অতএব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতর্ক চর্চার সুযোগ এবং পরিবেশ আরও প্রসারিত করা উচিত, যাতে আগামী প্রজন্ম যুক্তিবাদী ও সচেতন সমাজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে বিতর্কের প্রভাব : ১.বিতর্ক কেবল একাডেমিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে না, বরং সামাজিক জীবনেও এর প্রভাব গভীর। একজন বিতার্কিক সাধারণত সংবেদনশীল, যুক্তিবাদী ও পরিপক্ব মননের অধিকারী হয়। সে অন্যের মতামত সম্মান করে, সংঘর্ষের পরিবর্তে আলোচনা ও সমঝোতায় বিশ্বাসী হয়।
২.গণতন্ত্র চর্চা ও নাগরিক সচেতনতা: বিতর্ক ব্যক্তি ও সমাজকে মতপ্রকাশের অধিকার এবং মতানৈক্যকে সম্মান করতে শেখায়। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি রচনায় সহায়ক।
৩. মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস: প্রতিকূল যুক্তির মুখোমুখি হওয়া এবং তা মোকাবেলা করার অভ্যাস ব্যক্তি মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলে।
৪. বিতর্ক অভ্যাস মানুষের মধ্যে আলোচনা–নির্ভর সমস্যার সমাধান গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
যদিও বিতর্কের উপকারিতা অপরিসীম, তবে বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতর্ককে এখনও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষক, সময় ও উৎসাহের অভাব এই ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতর্ক প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই যুক্তি ও সৃজনশীলতার অনুশীলনে অংশ নিতে পারে। এইজন্য আন্তঃবিদ্যালয় ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিয়মিত আয়োজন করতে হবে, যাতে বিতার্কিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎকর্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়। বিতর্ককে পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, অন্তত উপস্থাপন দক্ষতা ও সমালোচনামূলক চিন্তা বিষয়ক পাঠের মাধ্যমে।
বিতর্ক এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা ব্যক্তি ও সমাজকে চিন্তার দিক থেকে মুক্ত, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ ও নৈতিকভাবে পরিপক্ব করে তোলে। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিতার্কিকরা আগামী দিনের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। তাই বিতর্ককে কেবল একটি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে না দেখে একটি শিক্ষাগত, সামাজিক ও নৈতিক চর্চা হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটি জাতি যত বেশি যুক্তিবাদী ও সৃজনশীল হবে, ততই তারা প্রগতিশীল ও সহনশীল হবে আর বিতর্কই সে জাতি গঠনের এক শক্তিশালী ভিত্তি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।