চট্টগ্রাম বন্দরে শিপিং এজেন্ট এবং বার্থ অপারেটরদের বিরোধ এবার তুঙ্গে। বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে গতকাল জরুরি বৈঠক করে বাড়তি মাশুল পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানো শিপিং লাইন্সগুলোর জাহাজে কন্টেনার হ্যান্ডলিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ রোববার বিকাল ৪টা থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। এদিকে গত দুদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থের কন্টেনার জাহাজে শিপিং এজেন্টদের পক্ষ থেকে ‘গো স্লো’ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে জরুরি পত্র দিয়ে শিপিং এজেন্টরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাশুল পরিশোধ করছেন না বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
বার্থ অপারেটর ও শিপিং এজেন্টদের চলমান বিরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে ধস নামার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। শিপিং এজেন্ট এবং বার্থ অপারেটরদের ‘অনবোর্ড’ হ্যান্ডলিং চার্জ ঠিক করে দিতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে বন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরি পত্র দিলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে জেনারেল কার্গো বার্থের ৬টি জেটিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এসব বার্থের অপারেটররা বেশ কয়েক মাস ধরে মাশুল বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। মাশুল বাড়ানোর দাবিতে অঘোষিত হ্যান্ডলিং কাজে ‘গো স্লো’ কর্মসূচি চলছে। একই সাথে গ্যাং কম বুকিং দেওয়া, ট্রেইলর ঠিকমতো না চালানোর মতো কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। বার্থ অপারেটর এবং শিপিং এজেন্টদের মধ্যে পারিশ্রমিক বাড়ানোর এই বিরোধের জের ধরে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাওয়া ছাড়াও আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও দুই পক্ষের বিরোধ না মেটায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।
বন্দরের প্রতিটি বার্থে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে দুই ভাগে কাজ হয়। কন্টেনার হুক পয়েন্ট থেকে জাহাজে ওঠানো–নামানোর (অনবোট হ্যান্ডলিং) কাজ করা হয় শিপিং এজেন্টদের পক্ষ থেকে। অপরদিকে হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ড পর্যন্ত কাজ করা হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে। অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি বার্থ অপারেটরের কর্মচারীরা কার্গো শিপমেন্ট, ইমপোর্ট বা এঙপোর্ট পারশিমন, ডিপো থেকে কন্টেনার কল, ভারী পণ্য বোঝাই কন্টেনার আগে জাহাজিকরণসহ বেশ কিছু বাড়তি কাজও করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মে অনবোট কন্টেনার হ্যান্ডলিং চলে আসছে। বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাশুল পরিশোধ করে শিপিং এজেন্ট বা ভ্যাসেল অপারেটর। অপরদিকে হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ডে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের মাশুল পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর। দুটি মাশুলই নির্ধারিত।
বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময়কালে যে দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সেই দরে তাদেরকে এখনো কাজ করতে হচ্ছে। গত ১৮ বছরে খরচ বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু অনবোট হ্যান্ডলিংয়ে বার্থ অপারেটরদের মাশুল বাড়েনি। তারা বলেন, অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য যে মাশুলটি দেওয়া হয় তাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর ৪০ শতাংশ শ্রমিকের খরচ এবং বাকি ৬০ শতাংশ বার্থ অপারেটরের মালিকের; যা দিয়ে বার্থ অপারেটররা ইকুইপমেন্টসহ বিভিন্ন খরচ মিটিয়ে থাকেন। শিপিং এজেন্টরা কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ৪০ শতাংশের ওপর প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ালেও বাকি ৬০ শতাংশের ওপর বাড়াননি। ২০০৭ সালের আগে তারা যেখানে প্রতি কন্টেনার অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা পেতেন। বর্তমানে পাচ্ছেন মোট ৫৫৯ টাকা ৫১ পয়সা করে। এতে করে প্রতিটি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে বার্থ অপারেটর এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তারা বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠি দেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ বৈঠকও করেন।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে শিপিং এজেন্টগণ এবং বার্থ অপারেটরদের সাথে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের অনবোর্ড রেইট বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকটি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছিল। পরে বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বারকে (হারবার অ্যান্ড মেরিন) আহ্বায়ক এবং শিপিং এজেন্ট ও বার্থ অপারেটর প্রতিনিধিদের নিয়ে অনবোর্ড হ্যান্ডলিং রেইট বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ৯ মার্চ মেম্বারের (হারবার অ্যান্ড মেরিন) সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। বৈঠকে বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৭ সাল থেকে অনবোর্ড হ্যান্ডলিং রেইট বাবদ প্রদত্ত চার্জে বার্থ অপারেটরগণের প্রাপ্ত অংশের কোনো রকম বৃদ্ধি করা হয়নি, সেহেতু বার্থ অপারেটরগণ অনবোর্ড হ্যান্ডলিং রেইট বঙপ্রতি ৫ ডলার বা ৬০০ টাকা হারে বাড়ানোর দাবি করে। পরবর্তীতে তারা বঙপ্রতি ৩৫০ টাকা হারে বর্ধিত করার দাবি জানান। বন্দর কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষের সাথে আলোচনা এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে অনবোর্ড লোড এবং খালি কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের বিদ্যমান দরের সাথে ২০৫ টাকা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত প্রদান করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তও কার্যকর হয়নি। শিপিং এজেন্টদের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তে অনীহা প্রকাশ করা হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ ৭ এপ্রিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য একটি পত্র দেয়। গতকাল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
এর মধ্যে বার্থ অপারেটররা বাড়তি চার্জ না পেয়ে কাজে ‘গো স্লো’ শুরু করে। বার্থ অপারেটরদের কাছে কোনো কোনো শিপিং এজেন্ট বঙপ্রতি ৫০ টাকা বাড়ানো যেতে পারে বলে মতামত দিয়েছে। কেউ কেউ বন্দর কর্তৃপক্ষের লিখিত নির্দেশ ছাড়া বাড়তি চার্জ পরিশোধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়।
বিষয়টি নিয়ে শিপিং এজেন্টদের সাথে বার্থ অপারেটরদের বিরোধ বাড়ে। গতকাল বার্থ অপারেটররা বৈঠক করে আজ বি শিফট অর্থাৎ বিকাল ৪টা থেকে যেসব শিপিং লাইন্স বাড়তি চার্জ পরিশোধ করবে না তাদের অনবোট হ্যান্ডলিং বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বার্থ অপারেটর্স, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর্স অ্যান্ড টার্মিনাল ওনার্স এসোসিয়েশনের নেতা ফজলে ইকরাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, যারা বাড়তি রেইট পরিশোধ করবে না আজ বিকাল ৪টা থেকে আমরা তাদের অনবোট হ্যান্ডলিং করব না। তবে বাড়তি চার্জ পরিশোধ করলে অবশ্যই হ্যান্ডলিং কাজ করব। বিষয়টি নিয়ে আজ আবার বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের কথা জানান। এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল আজাদীকে বলেন, আমরা আলোচনা করতে চাই। বার্থ অপারেটরদের নেতাদের অনেকে ফোন ধরছেন না। বন্দরকে জিম্মি করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক বঙে ২০৫ টাকা বাড়ানো যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, টাকাটা বিদেশি প্রিন্সিপ্যাল থেকে এনে দিতে হয়। তার জন্য একটি সার্কুলার দরকার। না হয় কী দেখিয়ে আমরা বাড়তি টাকা চাইব? বন্দর তথা জাতিকে জিম্মি না করার করার জন্য বার্থ অপারেটরদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়। এটারও সমাধান হবে।