বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি দেখার অনেক দিনের ইচ্ছা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি। যে বাড়িটি বাঙালি জাতির ইতিহাসের অন্যতম অংশ হয়ে আছে। এখানে বসে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সংগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার পৈতৃক বাড়িটি ছাড়া বঙ্গবন্ধুর এ একটি মাত্র বাড়ি। এ বাড়িতে তিনি সপরিবারে থাকতেন। বাঙালির অন্য দশটি পরিবার যেভাবে স্নেহ-মমতায় জড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনি একেবারে সাদাসিদে প্রাণবন্ত একটি পরিবার।
স্নেহময়ী মা পরিবারটি এমন করে গড়ে তুলেছেন, ভাইবোনেরা মায়া-মমতার এক অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ থাকতো। বাবার দীর্ঘ অনুপস্থিতি কখনো অনুভব করতে দেয়নি ছেলেমেয়েদের। আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর কাছেও তিনি হয়ে উঠেছেন একজন মমতাময়ী। বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরাও তাঁর কাছে থেকে পেতেন সহানুভূতি। ধীরে ধীরে তিনি সবার কাছে হয়ে উঠেন এক মহিয়সী নারী। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনিই দিতেন নানা রকম পরামর্শ।
বাড়িটির চারপাশে বেশ ফাঁকা জায়গা। গাছগাছালি আর সবুজ ঘাসে ভরা। গাছপালাগুলো সব সময় ছায়াময় করে রাখতো বাড়িটাকে। বাড়ির আঙিনা জুড়ে সবুজ চত্বরে পাখিদের আনাগোনাও দেখা যেতো। পাশের ধানমন্ডি লেকের পাখিরা এখানে এসে গাছের ডালপালায় বসে একটু জিরিয়ে নিতো। বাড়ির আঙিনায় অনেকগুলো কবুতর, যেন এ বাড়িটা এদের অভয়ারণ্য। সকালবেলা সারি সারি কাঠের বাসা থেকে কবুতরগুলো বেরিয়ে আসতো। জোড়ায় জোড়ায় ওরা বাসার ভেতর রাত কাটাতো। ভোর থেকে কবুতরের ডাকে পুরো বাড়িটা মুখরিত হয়ে উঠতো। বাসার দরজা খোলার সাথে সাথে পত পত করে উড়ে পাশের কার্নিশে গিয়ে বসতো। আবার কোনো-কোনোটা আকাশে উড়ে উড়ে ডিগবাজি খেয়ে নিচে নেমে আসতো। এ সময় এদের গম ছিটিয়ে খাবার দেওয়া হতো। গলা ফুলিয়ে বাকবাকুম শব্দে এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করতো। বাড়ির সবাই উপভোগ করতো। বঙ্গবন্ধুর কাছে খুব প্রিয় এসব কবুতর। তিনি যখনই বাড়িতে থাকতেন এদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন। নিজের হাতে খাবার দিতেন। এরাও উড়ে এসে বঙ্গবন্ধুর হাতে এসে বসতো।
গাছগাছালির প্রতিও তিনি যত্নবান থাকতেন। প্রায় সময় পানি দিতেন। কখনো কখনো বাগানে আগাছা পরিষ্কার করতেন। নিজের হাতে এসব কাজ করতে খুবই আনন্দ পেতেন। বাড়ির ছোট্ট ছেলেটিও বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে থাকতো। গাছের ডালে বসে থাকা পাখির দিকে তাকিয়ে দেখতো। কবুতরেরাও আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো। সে এসবের মাঝে ভারি আনন্দ পেতো। ছোট ছেলেটি সাইকেল চালাতে চেষ্টা করতো। বড় ছেলেটি খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো, খানিকটা দূরন্ত টাইপের। মেজ ছেলেটি কিছুটা চাপা স্বভাবের। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতো। মেজ মেয়েটিও অনেকটা এরকম। কিন্তু বড় মেয়েটি একেবারে বাবা-মার সবকিছু যেন নিয়ে এসেছে।
মেইন রোডের কাছে একেবারে রাস্তায় ধারে দ্বিতল এ বাড়িটি চিনে না, এমন কেউ নেই। বাড়িটিতে ঢুকতে বাম পাশে সিঁড়ি, ডানপাশে ড্রইং রুম। সাদামাটা মধ্যবিত্ত বাঙালি-পরিবারের ড্রাইং রুম। সোফাসেট হালকা পাতলা, টি-টেবল, বসার চেয়ার, ফুলদানি আর দেয়ালে চারটি ছবি। দুই নেতা হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দী ও এ কে ফজলুল হক এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ ড্রইং রুমটিতে তেমন কিছু নেই। আবার একটু খুটিয়ে দেখলে মনে হয় অনেক কিছু আছে। পাশের রুমটি লাইব্রেরির মতো। ওখানে শোকেসে অনেক বইপুস্তক। বিভিন্ন বিষয়ের বই। জ্ঞানবিজ্ঞানের, শিল্পসাহিত্যের, রাজনীতির ইতিহাস ও দর্শনের সব ধরনের বই। দেখলেই বুঝা যায় বইগুলো পড়া হতো। সময় পেলে বঙ্গবন্ধু বই পড়তেন। রাত জেগেও বই পড়তেন। কারাগারেও বই পড়ে তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। বইয়ের প্রতি তাঁর বড়ই ভালোবাসা। চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করার জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ কথাটি তিনি ভালো করে জানতেন। তাই বই পড়ার মতো একটি ভালো অভ্যাস গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু একাগ্র মনে বই পড়ার সময় কোথায়? দিনরাত এ বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা থাকতো। তিনি যখন থাকতেন তখন বাড়িটা কখনো কখনো ছোটখাট জনসভায় পরিণত হতো। শুধু দলের নেতা নয় কর্মীরাও তার কাছে আসতে পারতো। এক অদ্ভুত মায়াময় আকর্ষণ তাঁর মাঝে বিরাজ করতো। একবার যে তাঁর কাছাকাছি আসতে পেরেছে সে কখনো দূরে সরতে পারেনি। আশ্চর্য এক মোহনীয় ক্ষমতায় সবাই যেন আবিষ্ট হয়ে পড়তো।
পাশে রান্নাঘরটি একটু আলাদা। চুলা প্রায় সময় জ্বলতে থাকতো। এ বাড়িতে যারা আসতো কেউ না খেয়ে যেতে পারতো না। মমতাময়ী মা নিজের হাতেই রান্না করতেন। মূল বিন্ডিংয়ের ডাইনিং টেবিলে কখনো খাবার-দাবারের অভাব হয়নি। তিনি নিজেই খাবার পরিবেশন করতেন। এতই উদার মনে খাওয়াতেন, তৃপ্তি সহকারে সবাই খেতে পারতো। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে থাক না থাক তিনি এ মহৎ কাজটি সব সময় করতেন। শুধু ঘরের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি মা ছিলেন না, অনেকের কাছে স্নেহময়ী জননী হয়ে উঠেছিলেন।
সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দোতলায় শোয়ার ঘর। পর পর কয়েকটি রুম। পাশে একটি প্যাসেজ। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষটি একটু বড়সড়। একটি বড় খাট, তার উপর ম্যাট্রেস আর তোষক বিছানো। এর উপর বড় একটি অফ হোয়াইট চাদর বিছানো। সামনের দিকে একটি বেলকনি। এখানে দাঁড়ালে ধানমন্ডি লেক থেকে শুরু করে সব কিছু চোখে পড়ে। এ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতাকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতেন। জনগণের ভালোবাসার জবাব দিতেন। এখানে দাঁড়িয়ে কখনো কখনো নির্জনে তাঁর প্রিয় তামাকের পাইপে টান দিতেন।
দোতলা বাড়িটা একসময় তিন তলা পর্যন্ত উঠে। পাশাপাশি কয়েকটি রুম করা হয়। দুই রুমে নববিবাহিত দুই পুত্রবধূ থাকতেন। এখানে তেমন জাঁকজমক নেই, কোনো বিলাসিতাও নেই। একেবারে সাদামাটা রুমগুলো। সম্ভ্রান্ত বাঙালি-পরিবারের পুত্রবধূরা যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবে রুম দুটি সাজানো। আভিজাত্যের অহংকার কিংবা প্রাচুর্যের জৌলুস এরকম কোনো কিছু নেই। এখানে আছে একটি একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাইবোনের অকৃত্রিম বন্ধন, বাবা-মার মায়া-মমতার নিবিড় সান্নিধ্য। এ বাড়িতে যারা নববধূ হয়ে এসেছে তারাও যেন এ পরিবারকে আরো বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এ পরিবারের স্নেহ মায়া মমতার অকৃত্রিমতায় তারাও মুগ্ধ হয়ে পড়েছে।
মায়া-মমতার অকৃত্রিম বন্ধনে এ বাড়িটি অন্য দশটি বাঙালি-পরিবারের মতো হলেও এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে এ বাড়িটি সবার মাঝে আশা-আকাঙ্ক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় স্বাধিকার আন্দোলনে এ বাড়িটি মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে। এ বাড়ির প্রতিটি ইটও যেন আন্দোলন সংগ্রামের অংশ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ‘বাঙালি বাঙালি’ বলতে বলতে একসময় বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। এ বাড়িতে তারা ঠিকানা খুঁজে পায়। এ বাড়ির আঙিনায় সমবেত হতে থাকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষ। কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কেউ বাদ পড়ে না। সবার দৃষ্টি এ বাড়ির দিকে। এ বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।
ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি নিজের আত্মপরিচয়ের সুযোগ পায়। মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগ বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনে ধাবিত করে। বঙ্গবন্ধুর লালিত যে স্বপ্ন বাঙালি জাতিকে নিয়ে তা যেন এক নতুন মাত্রা পায়। তারই প্রতিফলন ঘটে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর কাছে মন্ত্রীত্বের চেয়ে বাঙালির অধিকার আদায় অনেক বড় ছিল। তাই তিনি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের পথে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে তুললেন।
জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, ষড়যন্ত্র মামলা, কোনোটাই তাঁকে থামাতে পারলো না। তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে অনড় থাকলেন। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ তৈরি করলেন। অসীম সাহসিকতায় ছয় দফা আন্দোলনের ডাক দিলেন। বাংলার মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দিলো। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুললেন। বাঙালিদের কে রুখে আর। গণ-আন্দোলন রূপ নিল গণ অভ্যুত্থানে। সামরিক জান্তার মসনদ ভেঙে পড়লো।
সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র বঙ্গবন্ধুর এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নিতে পারলো না। নানা চক্রান্ত শুরু করলো। ততদিনে এ বাড়িটি আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানেও এ বাড়িটি আন্দেলন সংগ্রাম থেকে দূরে থাকেনি। এ বাড়ির সেই মহিয়সী নারী- জননী তিনিই এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতেন।
সত্তরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রায় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু এ বাড়ি থেকে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষের যেন ঢল নামে এ বাড়িতে। মানুষ বুঝতে পারে ওরা বাঙালিদের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি চলে। প্রতিবাদী মানুষ চরম আক্রোশে ফেটে পড়ে। মানুষ আর ঘরে ফিরে যেতে চায় না। রাস্তা ঘাটে মাঠে ময়দানে জড়ো হতে থাকে।
মার্চে সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। এ বাড়িতে আসে প্রতিনিয়ত দেশি বিদেশি সাংবাদিক কূটনীতিক। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এ বাড়িতে তৈরি করেন বঙ্গবন্ধু। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন সবকিছু। জাতি সঠিক দিকনির্দেশনা পায়। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন তিনি। স্বাধীনতার ডাক দেন।
এরপর থেকে এদেশের সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। এ বাড়ি থেকে তিনি সবকিছু পরিচালনা করতে থাকেন। ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে এদেশের মানুষকে অকাতরে প্রাণ দিতে হলো। ২৬শে মার্চ ভোররাতে বঙ্গবন্ধু এ বাড়িতে বসে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সেদিনই পাক হানাদারবাহিনী তাকে এ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তাঁর সহকর্মীরা সবাই অন্যত্র সরে গেলেও বঙ্গবন্ধু এ বাড়ি ছেড়ে যাননি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনীর বুলেটের চিহ্ন দেয়ালের গায়ে লেগেছিল। এ সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। মৃত্যুকে তিনি কখনো পরোয়া করতেন না। কবরের ভয় দেখালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও’।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি এ বাড়িতে উঠেন। তখন এ বাড়িটি হয়ে উঠে বাংলার সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি এ বাড়িতে থাকতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক কোনো পরিচয়ে তিনি এ বাড়ি থেকে অন্যত্র থাকার চিন্তা করেননি। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। এ বাড়িতে তিনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। নিরাপত্তার কথা একবারও ভাবেননি।
বঙ্গবন্ধুকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। বারো বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। যতবার জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন প্রতিবার এ বাড়িতে এসে উঠেছেন। পরিবারের সবাই তাঁর ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো। অনেক সময় অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে পার করতে হতো। মাঝে মধ্যে খারাপ খবর আসতো। পরিবারের অনেকের খুব মন খারাপ হয়ে যেতো। কিন্তু মমতাময়ী মা সবাইকে যেন আগলে রাখতেন। শত বাধা বিপত্তি তাঁকে কখনো বিচলিত করতে পারতো না। তিনি চরম ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে সব কিছু সামাল দিতে পারতেন। পরিবারের মূল কাণ্ডারী ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তিনি সন্তানদের কাছে শুধু স্নেহময়ী জননী নয়, একজন দায়িত্ববান পিতার ভূমিকাও পালন করেছেন। সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সকল প্রতিকূলতার ভিতরও তাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাদের মাঝে গভীর মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু সাজানো বাড়িটা যে একদিন তছনছ হয়ে যাবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। বাড়ির পুরানো জিনিসপত্র কিংবা আসবাবপত্র নয়। ঘরদোর, বেলকনি, আঙিনা, সবুজ ঘাস, গাছপালা, লতাপাতা এমনকি পোষা কবুতরগুলো নয়। এ বাড়ির মানুষগুলো। যারা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রতীকে। যারা শুধু এ বাড়ির ছিল না, সমগ্র জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। শিশু বালকটিও রেহাই পেলো না, অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূরাও। যিনি শুধু পরিবারের কাছে নয়, আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী সবার কাছে ছিলেন মমতাময়ী মা সেই বঙ্গমাতাকেও প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যার বুকের রক্তে শুধু এ বাড়ির আঙিনা নয় সমগ্র বাংলার সবুজ শ্যামল মাটিকে রঞ্জিত করে তুলেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো এ বাড়িটিতে। যে হত্যাকাণ্ডে শিশু আছে, নারী আছে, অন্তঃসত্ত্বা নারী, রাষ্ট্রপতি আছে, জাতির পিতা আছে।
বাড়িটি বহুদিন থেকে বন্ধ। অনেকটা পরিত্যক্ত বাড়ির মতো। তবে পুলিশ প্রহরায় বাড়িটিতে প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। এত বছর যে বাড়িটি আনন্দ বেদনা হাসি কান্না আর আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতির অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল সে বাড়িটি এখন নীরব নিস্তব্ধ। দরজা জানালা সব বন্ধ। অনেকটা ভূতুড়ে বাড়ির মতো। গাছপালার পাখিগুলো নিঃশব্দে বসে থাকে। শোকবিহ্বল পায়রাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। শুকনো পাতারা সবুজ ঘাসের আঙিনায় যেন শোকের মিছিলে জড়ো হয়ে আছে।
পুলিশের সতর্ক পাহারায় বাড়ির সামনের রাস্তায় কোনো পথিকের আনাগোনা নেই। আশেপাশেও কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। যখন পনেরোই আগস্টের কালরাতে নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু হয় তখন ও বাড়িটি কেমন ছিল? দোতলা থেকে নামার সময় সিঁড়িতে যখন বুলেট বঙ্গবন্ধুর বুক বিদীর্ণ করে দেয়, তখন এ বাড়িটি কেমন করে কাঁপছিল! ভূকম্পনের মাত্রা কত ছিল? চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়নি বাড়িটি? বঙ্গমাতাকে যখন গুলিবিদ্ধ করলো তখন কি এ বাড়ির ছাদ উড়ে যায়নি? এ বাড়ির অন্যান্যদের যখন ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হলো তখনো কি বাড়িটি কেঁপে উঠেনি। শিশুপুত্র যখন মার কাছে যেতে চাইল তখন তাকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তাতেও কি এ বাড়ির ভিত ভেঙে পড়েনি। শুধু এ বাড়ি নয় সমগ্র বাংলার ভিত সেদিন ভেঙে পড়েছিল।
রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো এ বাড়ির মায়া-মমতা ছেড়ে কোনোমতে যেতে চাইল না। একদিন একরাত মেঝেতে পড়ে রইল। পরের দিন পরিবারের সবাইকে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানে তারা চিরনিদ্রায় শায়িত হলো। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বড় বিপদে পড়ে গেল। এ লাশ রাখবে কোথায়? এর উপযুক্ত সমাধি কোথায়? শেষ পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়ায় পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। পৈতৃক বাড়ির সামনে বাবার পাশে বঙ্গবন্ধুকে কবর দেওয়া হলো। এ বাড়িতে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। এ বাড়িতে তিনি ‘খোকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। এখানে তিনি বেড়ে উঠেছেন মধূমতি নদীর তীরে ছোট্ট এ গ্রামটিতে। এখানকার মানুষগুলোকে তিনি বড় বেশি ভালবাসতেন। এখান থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনও শুরু হয়। যে রাজনীতি তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা। তিনি ছিলেন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বনেতা। কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকতো এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে। এদের জন্য তিনি সারাজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। অত্যাচার নির্যাতন, জেল জুলুম সহ্য করেছেন। এদের অধিকারের জন্য তিনি জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিনি মৃত্যুর পরও আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন। পাড়া প্রতিবেশিরা তাঁকে গোসল করায়। গ্রামের মানুষেরা তাঁর জানাজায় শরীক হয়। দাফন কাফন সম্পন্ন করে। এ মহান নেতা গ্রামের বাড়িতে পৈতৃক ভিটায় বাড়ির আঙিনায় পিতা-মাতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
এ বাড়িটি অনেক দিন থেকে শূন্যতায় ডুবে আছে। বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। পাখিদেরও আনাগোনা নেই। দিন রাত একই রকম। ঘরের ভেতর-বাহির যেন অসীম শূন্যতায় ভরে আছে। বন্ধ দরজা-জানালা আর খোলা হয়নি। কোনো আলো ঘরে প্রবেশ করতে পারেনি। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো মেঝেতে পড়ে আছে। বিছানার চাদর কাপড়চোপড়ও যত্রতত্র পড়ে আছে। কাঁচের জিনিসপত্রও ভেঙেচুরে এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাড়ির প্রতিঘরের মেঝেতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বছরের পর বছর লাল এ রক্ত মেঝেতে যেন কালো প্রলেপ মেখে দিয়েছে। বড় পবিত্র এ রক্ত সহজে মুছে ফেলতে পারেনি। নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি এ বাড়ির স্মৃতিচিহ্নগুলো। শোকগাথা হয়ে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেই কালরাতে দেশের বাইরে থাকায় জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যান। এরা দুজন এ বাড়ির উত্তরাধিকার। তাঁরা আর দেশে ফিরে আসতে পারেন না। কয়েক বছর পর বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সেদিন বাংলার মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, নতুন আশায় বুক বাঁধে। মানুষের ঢল সেদিন আর থামতে পারেনি। কিন্তু অনেকদিন তাঁকে এ বাড়িতে যেতে দেয়নি। উত্তরাধিকার সূত্রে এ বাড়ির মালিক তিনি অথচ তাঁকে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অনেক আবেদন নিবেদন প্রতিবাদ মিছিলের পর একসময় তাঁকে বাড়িতে যেতে দিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী।
কত বড় দুঃখ, কত বড় কষ্ট বাবা মা ছোটভাইদের রক্তে রাঙানো ঘরের মেঝেতে পা রাখতে। হৃদয় ভেঙে যায়, অন্তর কান্নার স্রোতে ভেসে যায়, বুকের পাঁজরগুলো যেন চুরমার হয়ে যায়। বাবার রক্তমাখা পাঞ্জাবি, মায়ের রক্তমাখা শাড়ি, ভাইদের রক্তরঞ্জিত জামা, নববধূদের রক্তে রাঙানো কাপড়চোপড় আর প্রাণপ্রিয় আদরের ছোটভাইটির রক্তরঙিন টি শার্ট। এর চেয়ে আর বড় সম্পদ আর কী আছে? এসবই তো বুকে আগলে রাখতে হবে। কিন্তু এত শক্তি এত ধৈর্য কোথা থেকে পাবে? এ সাহস কোথা থেকে আসবে? এত কিছু ভাবার সময় কোথায়। সামনে অনেক কাজ। অনেক কঠিন সময় পার করিয়েছে। যার সব হারিয়ে গিয়েছে তার আবার হারানোর ভয় কিসের? তিনি পিতার মতো মৃত্যুকে জয় করতে চান। নিজেকে অনেক দৃঢ়তার উপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। এ বাড়ির বন্ধ দরজা-জানালা খুলে দেন। নিয়মিত এ বাড়িতে আসতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে শোকের কান্নায় বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে থাকলেও আবার আলো এসে এ বাড়িটাকে ধীরে ধীরে শক্তিতে পরিণত করে। এ দেশের মানুষেরা আবার যেন আলোর দিশা খুঁজে পায়। ছাত্র-তরুণ, নারী-পুরুষ সবাই যেন আবার জেগে উঠে।
একসময় বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় কন্যাও দেশে ফিরে আসনে। তখন আমরা অনার্সের ছাত্রী। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আমাদের বিমানবন্দরে যাওয়ার সুযোগ হয়। আমরা চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে ঢাকায় আসি। ঢাকায় তখন ছাত্র-জনতার মিছিল। আমাদের বাস ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে যেতে পারলো না। মানুষ সকাল থেকে বিমানবন্দরের আশেপাশে এসে জড়ো হয়েছে। গাড়ি আর ভেতরের দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বাস থেকে নেমে মিছিল করে বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে গেলাম। একজায়গায় গিয়ে আমাদের থেমে যেতে হলো। এত লোক সমাগম আমরা ভাবতেও পারিনি। চারিদিকে শুধু স্লোগান আর স্লোগান। বিমানবন্দর যেন থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। ছাত্র-জনতার স্লোগান। হাজার হাজার মানুষের স্লোগান যেন লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে। আকাশের বিমান বন্দরে অবতরণ করলো। তিনি বাংলার মাটিতে পা রাখলেন। তখন স্লোগানের বজ্রধ্বনি যেন কান্নার রোলে পরিণত হলো। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে সে কান্না আমাদের কাছে পৌঁছল। বিমান থেকে নামার সাথে সাথে বড়বোন ছোটবোনকে বুকে টেনে নিলেন। ছোটবোন বড়বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সে কি কান্না, আকাশ ফাটানো কান্না। বিমানের শব্দকে যেন হার মানালো। দুই বোনের বুকফাটা কান্নায় আশেপাশের সবাই নির্বাক হয়ে গেল। তারাও দু চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না। এদের আর্তনাদ যেন সবাইকে বিহ্বল করে দিলো। সে কান্নার অনুরণন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। তিনি কান্নামাখা চোখে হাত নেড়ে উপস্থিত সবাইকে অভিবাদন জানালেন।
সেদিন বিকেলে আমাদের একটা বড় সুযোগ হলো, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। যে বাড়িটি দেখার জন্য অনেকদিন থেকে অপেক্ষায় ছিলাম। যে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে ভাবতেও পারিনি এটা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ঐতিহাসিক সে বাড়িটি। বাড়ির পাশে সবুজ ঘাসের উপর আমরা বসেছিলাম। তখন পড়ন্ত বিকেল। আশেপাশের গাছপালার ছায়া এসে পড়েছে। বাড়িটা নিয়ে স্বপ্নের শেষ নেই, কল্পনারও শেষ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে নেত্রী আমাদের সামনে এলেন। একটি বেতের চেয়ারে বসলেন। হালকা রঙের শাড়ি পরেছেন। আমি একেবারে সামনের সারিতে বসেছি। আমার মনে হলো আমি আমার সত্যিকারের বড় বোনকে দেখতে পাচ্ছি। হালকা পাতলা গড়ন, চেহারাটা কত মায়াময়, সৌম্য আর শুভ্রতায় ভরা, যেন বাঙালি-পরিবারের বড় বোনের প্রতীক। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। ঠিক বক্তৃতা নয়, কিছু কথাবার্তা বললেন। তিনিও যেন আমাদের মাঝে খুঁজে পাচ্ছেন তার অনুজ দুভাইয়ের ছবি। ছোট ভাইটির কথা বেশি আর বলতে পারলেন না। মায়াময় চোখ দুটি দিয়ে জলের ধারা বইতে শুরু করলো। আমরাও সে জলের ধারায় আবেগ-আপ্লুত হতে চাইলাম। না, তিনি আমাদেরকে তাড়িত হতে দিলেন না। সে জলের ধারা মুছে দিয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ করালেন। কঠিন শপথ, দৃঢ়তার শপথ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শপথ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ গড়ার শপথ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক