রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন; যিনি বেগম রোকেয়া হিসেবে পরিচিত। বেগম রোকেয়াকে বলা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি প্রথম বাঙালি নারীবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বেগম রোকেয়া একাধারে একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত নারী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপেও উঠে এসেছে এই কৃতীর নাম।
বাঙালি বা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান অনস্বীকার্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূত হিসেবে লড়াই করে গেছেন তিনি। বেগম রোকেয়ার লড়াইকে স্মরণ করে নারী অধিকারকর্মী, নারী উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, নারীনেত্রীরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এখনো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। পাহাড়েও নারীদের জন্য বাধা কম নয়।
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী অপি সাহা বলেন, ২০২৫ সালে এসেও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা লক্ষণীয়। প্রধান বাধা হিসেবে আমি মূলত দেখতে পাই পরিবার এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা। এক্ষেত্রে নারীরা নিজেরাও কম দায়ী নয়। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, শুনে এসেছি নারীরা এ কাজ করতে পারবে না, ওই কাজ করতে পারবে না। নারীদের জন্য ‘না’ শব্দটি যেন সব ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক; পড়াশোনা, ক্যারিয়ার ও খেলাধুলা থেকে সব ক্ষেত্রেই। সমাজের সংকীর্ণ মনোভাবকে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রত্যেক নারীর প্রাপ্য অধিকার তাদের দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
নারী অধিকারকর্মী নুকু চাকমা বলেন, পাহাড়ি নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠে। আর একজন কন্যা শিশুর জন্ম থেকেই সেই বাধা সামাল দিতে হয়। হয়তো কন্যা শিশু জন্ম হলে কোনো কোনো পরিবার তাকে দত্তক দিতে চায় কিংবা অবহেলা করে। এরপর শিক্ষা গ্রহণের সময় এলে কন্যা শিশুকে বঞ্চিত করা হয়। ছেলে শিশুকে স্কুলে পাঠালেও কন্যা শিশুকে গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত রাখা হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই একজন কন্যা শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এরপরও যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে, তাদেরও পেশা নির্বাচনে কিংবা পেশা পছন্দে হিমশিম খেতে হয়। চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলোতে নারীদের সুযোগ দেওয়া হয় না।
সাংবাদিক জয়ন্তী দেওয়ান বলেন, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতায় নারীদের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে নারীর এই পথ চলার গতিপথ যে খুব মসৃণ এমনটি বলার অবকাশ এখনো নেই। এখনো অনেকে সাংবাদিকতাকে নারীদের পেশা মনে করেন না; বিশেষ করে পাহাড়ে। অনেক পুরুষ সহকর্মীর মাঝে একজন নারী কাজ করছেন, অনেক পাহাড়ি এটা মেনে নিতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায় নারী দেখে কথা বলা বা বক্তব্য দিতে চান না। তবে আমি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অনেক পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, বর্তমান সময়ে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্র, রাজনীতি, ব্যবসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। তবে নারীদের এই অগ্রযাত্রা এখনো নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। পাশাপাশি যৌন হয়রানি, রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে, এমনকি ঘরেও নারীদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, গৃহ নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। নারী নির্যাতন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয় না বা বিচার পেতে দীর্ঘসূত্রতা হয়। জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নারীদের সাহসী অংশগ্রহণ আছে। তবে বর্তমানে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
রাঙামাটি নারী উদ্যোক্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি রোজিনা ইসলাম রোজি বলেন, আমি নারী; নিজেকে সমাজের বোঝা হিসেবে নয়, শক্তিতে রূপান্তর করতে বিশ্বাসী। আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু একটি প্রশ্ন, নারীরা কি আসলে নিরাপদ? শহর থেকে গ্রাম সব স্থানে নারীরা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যে সকল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, তার মধ্যে আছে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাধা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ–টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও রাঙামাটি জেলা থেকে প্রথম নারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, নারীদের অগ্রগতির কথা বলছি, এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, সমঅধিকারের কথা বলছি। অথচ নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সবার আগে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তারপরই তো সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা।