নিজের ভেতর মূল্যবোধকে জাগাতে হবে

ড. গৌরী ভট্টাচার্য্য | মঙ্গলবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

মানবজীবনের বহুবিধ গুণাবলীর অন্যতম একটি হল মূল্যবোধ। মূল্যবোধ বিস্মৃত হলে আর যত শ্রেষ্ঠ গুণাবলী মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবে পরিণত করেছে তা অনেক দূরে সিটকে পড়ে। সৌন্দর্যবোধ, প্রেম,আনন্দ, মানবতা, নৈতিকতা সবই দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তখন মন থেকে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন সবই হারিয়ে যায়, এসব কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে বলে অনুভব করে না। ধ্যানধারণা বিকৃত হয়ে দয়া মায়াও লুপ্ত হতে থাকে।

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা হলো মনুষ্যত্বের সাধনা,সভ্যতার সাধনা। যখন মূল্যবোধের অভাব ঘটে তখন উদারবুদ্ধির পরিবর্তে সংকীর্ণ বুদ্ধি বিস্তার লাভ করে। ফলে মনুষ্যত্ব লোপ পেতে থাকে। মানবপ্রকৃতির চরম অধোগতির প্রাপ্তি ঘটে। অনেক প্রাচুর্যের মাঝে থেকেও মানসিক দৈন্যতার বিকাশ লাভ করে। মানুষের মনের ভিতর গুণ, অবগুণ দুটো দিকই আজীবন ক্রিয়াশীল থাকে। অবগুণ যখন বেশি ক্রিয়াশীল হয়, তখন মানুষের নির্মমতা পশুত্বের পর্যায়ে চলে যায়। মূল্যবোধ হারিয়ে তখন মানুষ ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপ করে, দুর্বল, নিরীহ মানুষ ও সমাজের ক্ষতি সাধন করতে সর্বদা তৎপর থাকে। মূল্যবোধহীন মানুষ পশুর তুল্য। আমাদের মনে রাখা উচিত হবে, দেশ, সমাজ, সংসার ও ব্যক্তির উন্নতি সাধন সবই একটি অপরটির পরিপূরক। সমাজকে, সুস্থ, সুন্দর ও ঐশ্বর্যপূর্ণ করে তুলতে হলে শিক্ষার মধ্যে মূল্যবোধের বিস্তার ঘটাতে হবে। তাই যদি আমরা করতে পারি তাহলেই সবার মূল্যবোধের জাগ্রত থাকবে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে মঙ্গলজনক হবে এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। শহরে, গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সকলেই সমৃদ্ধ হবে মননে, জগৎ ও জীবনে নিত্য নতুন বৈভব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। ধর্মীয় ঈর্ষাপোষণ সমাজে রোগব্যাধির মত, শুধু এইদেশে নয়, বিশ্বের বহুদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে সমাজের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই বিদ্বেষ মানসিক শক্তির ক্ষয় ছাড়া কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন থাকলে সৌহার্দ্য সমপ্রীতি বজায় থাকে। সমৃদ্ধ এবং উন্নত জাতি হিসেবে বাঙালি বিশ্বে মর্যাদায় আসীন হতে পারে, যদি নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর পরিবর্তে জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে সচেতন থাকে। সমৃদ্ধির পথে এগোনোর জন্য মানবিক মূল্যবোধ বিশেষভাবে সহায়তা করে। সকল ধরনের সংকীর্ণতা, হিংস্রতা, উগ্রতা থেকে মানব মনকে সত্যিকার অর্থে সুন্দর ও শালীন করে তোলে মানবিক মূল্যবোধ। সমাজ, সংসার ও দেশের সকল কল্যাণকর বিষয় এর উপর প্রতিষ্ঠিত।

আমাদের সমাজে এখনো পর্যন্ত অনেক নিষ্ঠুরতা, ব্যভিচার প্রতিনিয়ত ঘটছে, যার কারণে বাঙালির জাতীয় জীবন থেকে কলঙ্কের দাগ মোছা যায়নি। সমাজের কোণে কোণে অজ্ঞতায় কলুষিত, বুদ্ধিবিচার, যুক্তিবিচার, সব কিছুতেই আস্থার অভাব। কোথায় যেন আমরা তলিয়ে যাচ্ছি। জীবন চর্চা, সৌন্দর্য কল্পনা, প্রেম, জীবন প্রীতি, সবই যেন সমাজ থেকে নির্বাসন নিয়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের খুঁজে বের করতে হবে। সমাজের প্রতি দেশের প্রতি আমাদের প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করা যায় না। প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা আছে।

মানুষের জীবনে চাওয়ার কোনো শেষ নেই, অসীম চাওয়া পূরণ করতে গিয়েই জীবন দুঃখময় হয়ে উঠে। লোভ লালসায় আরও চায়, আরও চায় করতে করতে মূল্যবোধ কাজ করে না। সবাই শুধু নিজের সুখ নিজের লাভ, নিজের সবকিছু, নিজেকে মহান ভেবে অপরাপর, মানুষের কথা রাষ্ট্রের ক্ষতির কথা ভাবতে পারে না, তালে আমাদের জীবন যাপনের মহত্ত্ব কোথায় থাকলো? আমার প্রতিবেশীকে যদি হিংসা বিদ্বেষ করি তাহলে সেখান থেকেই তো গোটা সমাজ জাতি কলুষিত হতে থাকবে নানা প্রকার অপকর্মে। সৎকর্মই মানুষের ধর্ম। বিবেক, বুদ্ধি, ন্যায় থাকলে মনুষ্যত্ব থাকে। সমাজের প্রতিটি স্তরে যার যার অবস্থান থেকে নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করতে পারলে সমাজের উন্নতি সাধিত হয়। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটলে সমাজের উন্নতি নতুবা অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকবে সমাজ। আমাদের দেশ ও জাতি আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতো যদি সুস্থ ধারায় শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনে মনন তৈরি করতে পারত। পরিশেষে নির্দ্বিধায় বলি সমাজের বিদ্বেষপূর্ণ অসংগতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই আমাদের সমাজে সৌহার্দ্য সমপ্রীতি বজায় থাকবে, সভ্য এবং উন্নত জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি বিশ্বে অন্যতম মর্যাদা পাবে।