কক্সবাজার শহরসহ জেলার উপকুলীয় এলাকায় দ্রুত নেমে যাচ্ছে ভূ–গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। গত দু’মাস ধরে হাজার হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ বিকল হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির তীব্র সংকট চলছে। গত এক বছরে শহরের ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর আগের বছরের তুলনায় আরও ৮০ ফুট নীচে নেমে গেলেও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত একবছরে পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২শ ফুট! আর এরই মাঝে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।
বছর দেড়েক আগে কক্সবাজার শহরের এন্ডারসনরোডে ৩৮০ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসিয়ে মিষ্টি পানি পেয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম। কিন্তু এবছর সেই নলকূপের পানি আর পান করতে পারছেন না অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে। তবে তার নলকূপটি অকেজো হয়ে গেলেও তার প্রতিবেশী আতিকুল ইসলাম সিআইপি ৪৬০ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসিয়ে মিষ্টি পানি পেয়েছেন। আতিকুল ইসলাম সিআইপি জানান, মাত্র তিন দশক আগেও কক্সবাজার শহরসহ জেলাজুড়ে মাত্র ১০ থেকে ২৫ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়েই সারা বছর সুপেয় মিষ্টি পানি পাওয়া যেত। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় অগভীর নলকূপ থেকেই ঝর্ণার মতো অনবরত পানি বের হতো। সেই পানির স্তর ধীরে ধীরে কমতে কমতে এখন তা হাজার ফুটে গিয়ে ঠেকেছে।
তবে জেলা সদরের চেয়ে শোচনীয় অবস্থা উখিয়া–টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখানে ভূ–গর্ভস্থ পানি এত দ্রুত নীচে নেমে যাচ্ছে যে, প্রতিবছরই হাজার হাজার নলকূপ বিকল হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে এখানে পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২শ ফুট!
মিয়ানমারের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিক অধ্যুষিত উখিয়ার রাজাপালং ইউপি’র কুতুপালং ওয়ার্ড মেম্বার হেলালউদ্দিন জানান, মাত্র ৫–৬ বছর আগেও কুতুপালং–বালুখালীসহ পুরো উখিয়া–টেকনাফজুড়ে ৫০ থেকে ৮০ ফুটের মধ্যে নলকূপ বসিয়ে সুপেয় পানি পাওয়া যেত। গতবছর পানির জন্য ৭শ থেকে ৮শ ফুট গভীরে নলকূপ বসাতে হয়। আর এ বছর নলকূপ বসাতে হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ফুট গভীরে।
তবে কক্সাজার শহরের সমুদ্র তীরবর্তী হোটেল–মোটেল জোনে এখনও ৩শ ফুট গভীরতায় স্বচ্ছ পানি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ট্যুরিজম সার্ভিসেস এসোসিয়েশন কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার। কলাতলী হোটেল–মোটেল জোনের মতোই জেলার বাইরে চকরিয়া পৌর এলাকাতেও প্রায় ৩শ ফুট গভীরতায় স্বচ্ছ পানি পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেচপাম্পের জন্য কমপক্ষে ৪শ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসাতে হচ্ছে বলে জানান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭ টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের জন্য পানির কোন না কোন উৎস রয়েছে। কিন্তু নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা মাত্র ৫৬ ভাগ মানুষ। পানিকে সমস্ত প্রকৃতির চালিকাশক্তি বলা হয়। সকল জীবন্ত প্রাণি ও উদ্ভিদের জন্য জ্বালানি হিসাবে বিবেচিত পানি।
স্থানীয় সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ১০ হাজার নলকূপ থেকে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে ভূ–গর্ভস্থ উৎস হতে। আর জেলা সদরের হোটেল–মোটেল জোনের প্রায় ৫শ হোটেলে উত্তোলন করা হচ্ছে অন্তত ১ কোটি লিটার ভূ–গর্ভস্থ পানি। ভূ–গর্ভস্থ উৎস হতে এভাবে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূ–গর্ভস্থ মিঠা পানির মজুদে লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, গত তিন দশকে কক্সাজারে ভূমির ব্যবহারে ব্যাপকমাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এতে ভূ–গর্ভস্থ পানীয় জলের জলাধারের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম মতে, পাহাড়কাটা, বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে কক্সবাজার পরিবেশগতভাবে এখন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিগুলো বহুবর্ষজীবী জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, পৃথিবীতে ছয় ধরনের আলাদা বাস্তুতন্ত্র চিহ্নিত রয়েছে। এগুলো হল বনভূমি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক টুন্ড্রা। কিন্তু এদেরও একটির উপর আরেকটির নির্ভরশীলতা এবং প্রভাব রয়েছে। যেমন পানি চক্রের সাথে সমুদ্র ও বনের বাস্তুতন্ত্র নির্ভরশীল। কোনো বাস্তুতন্ত্রে পানিচক্র, কার্বন চক্র, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রের যথাযথ প্রবাহ বজায় না থাকলে তার ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। তাই কক্সবাজারে ভূ–গর্ভস্থ পানি সংকটের জন্য বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়াকে দায়ী করা যায়।