খ্রীষ্টীয় নতুন বছরে কেমন
স্বদেশ চাই আমরা?
৫০ বছর একটি জাতির জীবনে কম কোন সময় না। বাংলাদেশের জন্ম দেখেছি আমি। আমি এদেশের সে প্রজন্মের সন্তান যারা আমেরিকা ইউরোপ থেকে সাহেব মেমের ব্যবহৃত পুরনো কাপড় পরে ষ্টাইল করতাম। আমাদের জন্য বাতিল গুঁড়ো দুধ পাঠাতো কানাডা। আমাদের দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করতো কিসিঞ্জার নিকসনের মার্কিন মুলুক। যে চীন এখন উন্নয়নের অংশীদার বলে গর্বিত সে আমাদের স্বীকৃতি ই দিতে চায় নি। যে সব আরবদেশকে আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম বলি যাদের জন্য টাকা তুলে পাঠাই যাদের দেশে গিয়ে যুদ্ধ করি তারাও আমাদের মানতে চায় নি। নানা ধরনের অপবাদ আর মিথ্যা চক্রান্তে আমাদের জনম বৃথা প্রমাণ করার জন্য মরিয়া পাকিস্তান তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছিল। একমাত্র বঙ্গবন্ধু ই বলেছিলেন, বাংলাদেশ আছে থাকবে কেউ তাকে দাবাতে পারবে না। আর যেটা সত্য তা হলো এই বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ার কান্ডারী ছিলেন সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন আহমেদ। সে সব চার জাতীয় নেতা ও আজ বিস্মৃতির ধূলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন।
একটি বেলবটম প্যান্ট সেলাই করে তিনরাত নির্ঘুম কাটানো আমাদের কষ্ট ও আনন্দ বুঝবে না আজকের প্রজন্ম। বুঝবে না কি যন্ত্রণা আর অভাব আমাদের ঘিরে রেখেছিল। কলকাতাকে তখন স্বর্গ মনে হতো আমাদের। ওদের দেশে তখন আঙুরের কেজি দশ টাকা আর আমাদের একশ টাকা। সে সময় একশ টাকা যোগাড় করতে পারা বিশাল ঘটনা। কলকাতায় দোকানে দোকানে ঝোলানো সারি সারি আঙুর দেখে দেশে ফিরে আঙুর শুন্য বাজারে মনে হতো আমরা কি না খেয়েই থাকবো আজীবন? আজ সেসব অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে দেশ। একথা স্বীকার করতেই হবে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের আমলেই একটু একটু করে ঘুরে দাঁযাতে শেখা দেশ এখন উন্নয়নের রথে। দেশে গেলেই বোঝা যায় মানুষের হাতে টাকার অভাব নাই। করোনার আগে এটা সর্বজনীন মনে হতো। কিন্তু করোনার পর ঘুষ দুর্নীতি চুরি লুট বন্ধ না হলেও বন্ধ হয়ে গেছে আয় রোজগার। থমকে গেছে বহু মানুষের স্বাভাবিক জীবন। ৫০ বছরের বাংলাদেশ উন্নয়ন আর সচ্ছলতা যতোটা পেয়েছে ততোটাই হারিয়েছে তার সমাজ শৃঙ্খলা আর বাঙালিয়ানা।
আজকে বাংলাদেশে কথায় কথায় দাঙ্গা হাঙ্গামা আর যৌনতার ছড়াছড়ি। লাগাতার ধর্ষণ বলৎকার এসব হতে হতে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে মানুষকে আর এসব জাগাতে পারে না। যেন এটাই স্বাভাবিক। দাঙ্গা হাঙ্গামার জন্য একসময় আমরা রাজনীতিকে দাবি করতাম কিন্তু এবার কি দেখলাম? রাজনীতিবিহীন এক তরফা খেলার মাঠে হিন্দু সমপ্রদাবের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে হামলা আর সামপ্রদায়িকতার হুংকার। যে অসহায়ত্ব দেখেছি তা কোনদিন ছেড়ে কথা বলবে না। অচিরে এই পরিণতি দেখতে হবে সংখ্যাগুরুদের বেলায়ও। কারণ হিংসা হানাহানি কখনো ছেড়ে কথা বলে না।
বস্তুত বাংলাদেশের যাবতীয় অর্জন সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব হয়ে উঠেছে। যেমন কৃষি শ্রমবাজার আর গার্মেন্টস এগুলো যারা করেন তাদের সবাই সাধারণ মানুষ। যারা রাজনীতি বোঝে না। দরকার ছিলো একটি দীর্ঘ মেয়াদী সরকার আর নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর দেশশাসনে থাকার ফলে দেশ স্থিতিশীল সরকার পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেগেটিভ যতো কিছু থাক না কেন সরকার পরিচালনায় তাঁর একক কর্তৃত্ব আমাদের দেশকে পিছিয়ে পড়তে দেয় নি। ফলে বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে গেছে। বরং আপনি যদি ভালো করে তাকান দেখবেন যা কিছু অপকর্ম আর জাল জালিয়াতি সব রাজনীতিসৃষ্ট। উপমহাদেশে কোন দেশ ই তার আগের জায়গায় নাই। কমবেশী সবাই এগুচ্ছে। যার যার মতো করে আগুয়ান দেশগুলোর সাথে আমাদের তফাৎ দুটো। এক, আমাদের এমন এক জায়গায় অবস্থান যা কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শ্রমজীবী জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তা বা তাদের বিনিয়োগও বেশী। বাংলাদেশ তাই অন্যদের পিছে ফেলে এগিয়ে চলেছে। দ্বিতীয়ত আমরা বাকী দেশগুলোর মতো নিজেদের স্বকীয়তা কিংবা চরিত্র ধরে রাখতে পারছি না। ক্রমাগত ভাবে বাঙালীয়ানা থেকে পিছিয়ে পড়ছে জাতি। আজকাল পোশাক খাবার কিংবা ভাষা কিছু দেখে বা শুনে বোঝার উপায় নাই এদেশে একদা বাঙালী হবার সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল।
৫০ বছরের বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ভালো থাকলেও তার সমাজ পচনশীল। সব জাতির একটা দিক নির্দেশনা থাকে। পাকিস্তানকে আমরা ভালো খারাপ যাই বলি না কেন তারা তাদের পথ বেছে নিয়েছে। সবাই জানে পাকিস্তান মানেই উগ্র জাতির দেশ। যাদের নিয়ম মানানো কষ্টসাধ্য। যারা মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে আজ এক অসহায় বিকৃত সমাজের শিকার। কিন্তু মুখে যত কথা বললেও বাংলাদেশের হাল হকিকত কি খুব ভালো? কি কথা ছিল বা কি দেখছি আমরা?
বেশী দূরে যাবো না। ক দিন আগেই একজন মন্ত্রীকে দেখলাম যাকে কানাডা ভিসা থাকার পরও ঢুকতে দেয় নি। যাকে গ্রহণ করে নি আরবের দেশ। এটা কি সমাজ বা জাতির জন্য আনন্দ বা গর্বের সংবাদ? তার মুখের ভাষা বা তার বিকৃতি আমাদের ঘুমাতে দেয় নি। অথচ একটি অডিও ফাঁস না হলে আমরা এর কিছুই টের পেতাম না। মানুষ বলাবলি করছে এমন মন্ত্রী না কি অনেক এরচেয়েও খারাপ মানুষেরা ঘিরে আছে আমাদের ওপরতলা। তাহলে নীচের তলা সাফ সুতোর হয় কি করে? ৫০ বছরের বাংলাদেশ এমন নেতা পয়দা করেছে যে হাসপাতাল খুলে করোনার মতো ভয়াবহ রোগের ভুয়া সাটিফিকেট দিতে ভয় পায় না। এমন সব আমলা যারা বছরে বিদেশ ঘোরা আর প্রবাসে বাড়িঘর বানানো ছাড়া কিছু বোঝে না। আমাদের পুলিশের ওসি টেকনাফে তার রাজত্ব কায়েম করে অথচ কেউ কিছু জানে না এটাও কি সম্ভব? এ লেখা যখন লিখছি তখন পর্যটন নগরীতে ট্যুরিস্ট ধর্ষণ নিয়ে মিডিয়া সরগরম। অথচ পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা ।
বিগত বছরগুলোয় নানাভাবে আমরা সাধারণ মানুষকে অপমান আর প্রাণ হারাতে দেখেছি। ছাত্র যুবা মধ্যবয়সী নারী কেউই আর নিরাপদ না। সবচেয়ে বড় কথা বিচারহীনতা। মাঝে মাঝে ফাঁসির খবর শোনার বাইরে ধারাবাহিক কোন বিচারের কথা শোনা যায় না। আর অপরাধও তাই ক দিন পর পর নতুন নতুন রূপে হাজির হয়। বাংলাদেশ এখনো স্বপ্ন আর সাহসের ওপর ভর করে বেঁচে আছে। কারণ তার ভরসা সাধারণ মানুষ। যারা অসামপ্রদায়িক এবং পরিশ্রমী। যারা দল বোঝে না তবে ইতিহাস বোঝে। যারা অপমান মেনে নেয় কিন্তু দলন সহ্য করে না।
শেষ করবো এই বলে, বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা অফুরন্ত আশা যদি জাগতে না পারে তার দায় মানুষের না। মানুষ চেয়েছে চায় কিন্তু একমুখি রাজনীতি অগণতান্ত্রিকতা আর আল আমলে স্তবিকতা এদেশের সবকিছুকে এমন এক কদর্য রূপ দিয়েছে যা আগে কেউ দেখে নি। পরিবেশ এতোটাই খারাপ বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মুজিব বর্ষ বানানটিও কেউ পড়ার সময় পায় না। ভয় হয় ১০০ বছরের এই দেশের চেহারা কেমন হবে? আমরা কেউই থাকব না সে সময়। আরো গোটা দুই প্রজন্ম থাকবে না। যারা থাকবে তারা কি আদৌ জানবে সঠিক ইতিহাস এবং বাঙালি নামের কোন জাতি সত্তার পরিচয়? পতাকা গান সীমানা বা ইতিহাস বারবার তার রূপ নেয় রূপ বদলায় ও কিন্তু থেকে যায় মাটি আর মানুষ। তাদের বড় করে তুললে তাদের ভালোবাসেই বাংলাদেশ আপন মহিমায় দীর্ঘজীবী হবে। নববর্ষে এটাই প্রার্থনা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট