দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মন ভরে গ্রাম দেখা না গেলেও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে ঘোরাঘুরি করতে বেশ ভালোই লাগছিল। খোলা মাঠ, উদোম হাওয়া, নারী পুরুষের পথ চলা, লেটুস ক্ষেতে প্রজাপতির ওড়াওড়ি কিংবা কলাবাগানে পাখীর কিচিরমিচির সবই মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। সবুজে সবুজে একাকার হয়ে উঠা গ্রামটি যেনো মিলেছিল পাহাড়ে। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। কী আদর মাখা এক একটি পাহাড়, কী দারুণ সবুজ!! পাহাড়গুলোর হাতছানি আমাকে বেশ টানছিলো। আমাদের থেকে পাহাড় কতদূরে জানতে চাইলাম। ড্রাইভার বললো, /৩ কিলোমিটার হবে। সে একটি পাহাড়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, ওই যে, দ্য পিক। যেখানে আমরা গিয়েছিলাম। যাবেন নাকি আবার? পাহাড় দেখবেন?

আমি হাসলাম। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য কেন্দ্র, বিশ্বের প্রধানতম সমুদ্রবন্দরগুলোর একটি, ছোট্ট একটি দ্বীপ হংকংয়ে জায়গার বড় অভাব। এর মাঝেও দ্য পিক অনেকখানি জায়গা দখল করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা হলে কত আগেই পাহাড়ের পর পাহাড় সাবাড় করে শত তলা উচ্চতার ভবন বানিয়ে ফেলতাম!

ড্রাইভারকে ‘চল, যাই’ বলে ফিরে আসার পথ ধরতে বললাম। আমার বন্ধুকে অফিস থেকে তুলতে হবে। ঘরে ফিরতে হবে, ভাবী লাঞ্চ নিয়ে বসে থাকবেন।

ড্রাইভার বললো, ‘তাড়া নেই। স্যারের বের হতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের হাতে অনেক সময়।’

যাত্রা করলাম। ড্রাইভার বললো, চলেন, এবার অন্যপথে অন্যদিকে যাবো। দারুণ একটি জিনিস দেখাবো আপনাকে। এখন বলবো না। শুধু দেখার পর বুঝবেন যে কী জিনিস দেখিয়েছি আপনাকে! আমি বেশ চমকিত হলাম। ড্রাইভার হলেও হংকং সম্পর্কে দারুণ আইডিয়া তার। বছর কয়েক থাকার কারণে অনেক কিছুই তাকে শিখতে হয়েছে। আর গাড়ির মালিকের বহু কিছু না জানলেও চলে, চালকের সবকিছু জানতে হয়। তাই সে অনেককিছু জানে। চালক ‘দারুণ’ বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছে তা না বুঝলেও ভালো কিছু একটা যে দেখতে পাবো তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।

গাড়ি চলছিল। অলস চোখ বাইরে রেখে বসে ছিলাম আমি। চারদিকের নানা ব্যস্ততা বেশ টের পাচ্ছিলাম। অগুনতি গাড়ি ছুটছে। সারি সারি গাড়ি। ফুটপাত এবং সাইকেল রোড ধরেও ছুটছে মানুষ, সাইকেল। কত রকমের সাইকেল যে দেখা যাচ্ছিল! তিন চাকার সাইকেলও দেখলাম, বেশ লম্বা। বাচ্চা কাচ্চাদের সাইকেলে বসিয়ে পথ চলছে সৌখিন মানুষ।

পাহাড়ের কাছাকাছিতে চলে এসেছি আমরা। হংকংয়ে বুঝি পাহাড়ের অভাব নেই। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে রাস্তা, দুপাশে প্রচুর গাছগাছালী। পাহাড় শেষ হলো, তবুও পথ ফুরোলো না। আমরা ছুটছিলাম সামনে। কোথায় যাচ্ছি তা নিয়ে কৌতুহল হলেও ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। আমার তো কোন তাড়া নেই, যেখানেই যাক না কেন, নতুন কিছু তো দেখা হবে। রাস্তার পাশে চমৎকার রেল লাইন। সেই লাইন ধরে একাধিক ট্রেন যেতেও দেখলাম। তেমন বড় ট্রেন নয়, মাত্র কয়েকটি বগির ছোট্ট ট্রেন। ট্রামের মতো। তবে ট্রাম চলতে দেখেছি আস্তে, এটির বেশ গতি। ট্রেনের বগিগুলো দেখে কী যে ভালো লাগছিল! ভিতরে লোকজন দাঁড়িয়েও ভ্রমণ করছে। সিটে বসে বই পড়ছে এমন যাত্রীও দেখা যাচ্ছিল কাচের ভিতর দিয়ে! আহারে, ট্রেনে চড়তে পারলেই হতো!

অদূরে খলখল করে হেঁসে উঠলো নদী। নদী নাকি সাগরের অংশ তা বুঝতে পারছিলাম না। চীন সাগরের অংশ এই হংকং দ্বীপ। সাগরের শাখা হিসেবে নদীও রয়েছে অনেক। গাছ গাছালীর ভিতর দিয়েও ঝলকে ঝলকে উঠছিল সাগরের নোনা জল। ক্ষণে ক্ষণে অদৃশ্য হচ্ছিল, আবারো দেখা দিচ্ছিলো। যেনো এক লুকোচুরি খেলা!

ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি রাখতে চলে গেলো। সে চাইলে আমাকে সাথে নিয়ে পার্কিং এ গিয়ে গাড়ি রেখে আবার আমাকে সাথে করে হাঁটিয়ে আনতে পারতো। কিন্তু বসের বন্ধু হিসেবে সম্মান করে আমাকে হাঁটাহাঁটির কষ্ট থেকে মনে হয় বাঁচিয়ে দিচ্ছিলো।

সড়কের পাশে ফটুপাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। আমার পাশ দিয়ে বহু নারী পুরুষ আসা যাওয়া করছিল। এদের কাউকে কাউকে থ্রি কোয়ার্টার বা শর্টস পরে ফিরতেও দেখলাম। কেউ কেউ ভিজে জুবুথুবু অবস্থা। হয়তো সাগরে দাবড়িয়ে উঠে হোটেলের পথ ধরেছে।

ড্রাইভার ফিরে আসলো। আমাকে সামনে এগুবার ইশারা দিয়ে সে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুটা এগুনোর পর আমরা একেবারে এক্সক্লুসিভ একটি ওয়াকওয়েতে এসে পড়লাম। বেশ লম্বা, ইটের মতো করে পিছ করা। ওয়াকওয়ের পাশে একটি আইল্যান্ড, আইল্যান্ডের পরে রাস্তা। আইল্যান্ডে অসংখ্য বটগাছের মতো গাছ, যেগুলো থেকে দড়ির মতো ঝুল নেমেছে। কী যে সুন্দর এক একটি গাছ। নিয়মিত দুরুত্বে গাছগুলো রোপণ এবং বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। সবগুলো গাছই একই রকম, যেনো ধ্যানমগ্ন ঋৃষী! মাঝারী উচ্চতার গাছগুলোর ঢালপালা আইল্যান্ড ছাপিয়ে একপাশের ওয়াকওয়ে এবং অন্যপাশের রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। ছায়ায় মায়ায় যেনো সবকিছু ঢেকে রেখেছে!

হাঁটছিলাম আমরা। খেয়াল করে দেখলাম যে, ওয়াকওয়ের উপরে দোচালার মতো রঙিন ছাদ দেয়া। টিনের বলে মনে হলো, নাকি সিমেন্ট দিয়ে টিনের আদল দেয়া হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। চওড়া ওয়াকওয়ের পুরোটাই ছাদে ঢাকা। গাছের পাতা পড়ে যাতে পথ নষ্ট না হয় কিংবা গাছে বসা পাখি যাতে পথচারীদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে না উঠে সেজন্য এই ছাদ বলে মনে হলো। তবে দেখতেও দারুণ লাগছিল।

ওয়াকওয়ের পাশেই কলকল করছিল সাগরের ঢেউ। বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধ তৈরি করে তার উপরই ওয়াকওয়ে বানানো হয়েছে। ওয়াকওয়ের মাঝে মাঝে বসার জন্য চমৎকার ডিজাইনের সিমেন্টের বেঞ্চ। অনেকেই বসে আছে। আবার অনেকগুলো খাঁ খাঁ করছে। প্রেয়সির হাতে হাতে নিয়েও কয়েকজনকে বসে থাকতে দেখলাম। কেউ কেউ প্যাকেট থেকে বাদামের মতো কি সব খাচ্ছে। সাতরাজ্যের সব তৃপ্তি এবং আনন্দ তাদের চোখে মুখে। আমরা হাঁটছিলাম ওয়াকওয়ে ধরে, পাশে সাগরের কলতান। মন ছুঁয়ে দেয়া চমৎকার জায়গাটি অন্যরকমের এক আবহ তৈরি করে রেখেছে। এই মুগ্ধতা অনুভবের, লিখে বুঝানোর নয়। কী যে শান্তি লাগছিল। মানুষের কিলবিল ভাব নেই, গাড়ির বিশ্রি হর্ণ নেই, হকারের হাকডাক নেই, ভিক্ষুকের আকুতি নেই। অন্যরকমের এক নিরবতা ভরে আছে চারদিকে। এরমাঝে নতুন পাখির নাচানাচি বেশ মজা দিচ্ছিল। শত শত পাখি। ডাহুক এবং দোয়েল জাতীয় অসংখ্য পাখি ওড়াওড়ি করছিল। পাখিগুলো কিছুক্ষণ পাথরের বাঁধে, আবার টুক করে গাছের ঢালে গিয়ে বসছিল। এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল পাখির শিকারযজ্ঞ। তারা নানা ধরনের পোকামাকড় ধরে ধরে খাচ্ছিল। পাশ দিয়ে যে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম তাতে তাদের কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছিল না। সহজ করে বললে একটি পাখিও আমাদের কিংবা অন্য পথচারীদের ভয় পাচ্ছিলো না।

ছাদের তলায় থাকা ওয়াকওয়ে শেষ হলো। এবার আমরা উন্মুক্ত রাস্তায় এসে পড়লাম। সাগর পাড়ের রাস্তা। চোখের সামনে কলকলিয়ে উঠলো সাগর, বিচ। বাটারফ্লাই বিচ। আকারে তেমন বড় না হলেও বেশি সুনশান, সুন্দর এবং সাজানো গোছানো। গাছগাছালির নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা, আরো অনেক পর্যটক। শানবাঁধানো রাস্তা থেকে পানির কাছাকাছিতে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে সিঁড়ি করে দেয়া হয়েছে। এখানেও বটগাছের মতো গাছগুলো দেখা গেলো। তবে কাছেই অসংখ্য বড় বড় ভবন। আবাসিক হোটেল বা ‘অফিসটফিস’ হবে বলে মনে হলো। সবগুলো ভবনই প্রায় একই উচ্চতার, চল্লিশ পঞ্চাশ তলা হবে মনে হয়। দেখতেও অনেকটা একইরকম। সারি করা সুুউচ্চ ভবনগুলো সাগরপাড়ে ভিন্ন এক দৃশ্যপট তৈরি করেছে। ছবির মতো সুন্দর লাগছিল ভবনগুলোকে। নদীর একপাড় জুড়ে সারি সারি ভবন হলেও অন্যপাড়ে মাঝারী উচ্চতার পাহাড়। বিচের পাশেই পাহাড়। পাহাড়ে অগুনতি গাছগাছালী। বিচেও গাছ। সাগরের নোনতা বালিতে কী করে যে এত এত্ত নারিকেল গাছ জন্মিয়েছে কে জানে! প্রতিটি নারিকেল গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় ডাব, নারকেল। বিধাতা যাদের দেয়, তাদের বুঝি সবদিক দিয়েই দেয়!অকৃত্রিম এই দেয়ার মাঝে দারুণ যে নান্দনিকতা তা আমাদের মন ভরিয়ে দিচ্ছিলো। (চলবে)

লেখক: চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁধ দিয়ে তৈরি করা লেকের কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৯ সদস্যের কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধমধুসূধনের ইংরেজি সাহিত্য চর্চা: একটি সংক্ষিপ্ত সমীক্ষা