ইতিকাফের সংজ্ঞা: ইতিকাফ শব্দিটি আরবি, “আক্ফুন” মূল ধাতু থেকে নির্গত। আকফ অর্থ অবস্থান করা। শরীয়তের পরিভাষায় যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাত সহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দ্যেশে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে ইতিকাফের গুরুত্ব: পবিত্র রমজান মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের নাম ইতিকাফ। এর ফযীলত পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন স্মরণ কর, সে সময়টার কথা যখন আমি কাবা গৃহকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর, এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আমার গৃহ তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম। (সূরা: বাকারা: ১২৫)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “স্ত্রীদের সাথে তোমরা সহবাস করো না যখন তোমরা মসজিদগুলোতে ইতিকাফরত থাকো। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৭)
হাদীস শরীফের আলোকে ইতিকাফ করার ফযীলত: রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা সুন্নাত “হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। তিনি তাঁর ওফাত পর্যন্ত এভাবে ইতিকাফ করেন অত:পর তাঁর স্ত্রীগন তাঁর পরে ইতিকাফ করেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশদিন ইতিকাফ করতেন, এক বছর সফরে যাওয়ায় ইতিকাফ করতে পারেননি তাই যে বছর ওফাত বরণ করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)
একবার হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জাহেলী যুগে মসজিদুল হারামে একরাত ইতিকাফের মান্নত করেছিলাম, প্রতি উত্তরে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন তুমি তোমার মান্নত পূর্ণ করো।
হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিনের ইতিকাফ করলো সে যেন দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরা আদায় করলো। (বায়হাকী শরীফ)
ইতিকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া: ইতিকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। যদি মহল্লা বা এলাকার মসজিদে কেউ ইতিকাফ না করে তবে সুন্নত পরিত্যাগের কারণে সংশ্লিষ্ট মহল্লার সকলেই গুনাহগার হবে। যদি একজনও ইতিকাফ পালন করে তবে সকলেই দায়মুক্ত হবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে লায়লাতুল কদর তালাশ করা এবং এ রাতের সওয়াবের অধিকারী হওয়া। রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ পালনে নিয়ম হলো রমজানের বিশ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে এবং ত্রিশে রমজান সূর্যাস্তের পর বা উনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হবে। যদি বিশ তারিখ মাগরীব নামাযের পর ইতিকাফের নিয়ত করল তাহলে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ আদায় হবেনা। (দুররুল মোখতার, আলমগীর, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫, পৃ: ১৮১)
ইতিকাফের জন্য শর্ত: ই’তিকাফের জন্য মুসলমান, বুদ্ধিমান হওয়া শর্ত। নারীরা হায়েয ও নিফাস হতে পবিত্র হওয়া শর্ত। ইতিকাফের জন্য জামে মসজিদ হওয়া শর্ত নয়। (রদ্দুল মোখতার, আলমীরি, ১ম খন্ড)
মাসআলা: মক্কা মোকাররমার হেরম শরীফে ইতিকাফ থাকা সর্বোত্তম, অত:পর মসজিদে নববীতে অত:পর মসজিদুল আকসায়, অত:পর যে মসজিদে বড় জামাত হয়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ১৮০)
মাসআলা: মহিলারা মসজিদে ইতিকাফ থাকা মাকরুহ বরং ঘরের মধ্যে তারা ইতিকাফ করবে, তবে এমন স্থানে করবে যা নামায পড়ার জন্য নির্ধারিত রেখেছে যেটাকে ঘরের মসজিদ বলা হয়। মহিলার জন্য ঘরে নামাযের জন্য একটিস্থান নির্ধারণ করে রাখা মুস্তাহাব। এবং সে স্থানটি প্লাট ফর্মের ন্যায় উচু করবে। পুরুষের জন্যও ঘরে নফল নামায আদায় করার জন্য একটি স্থান নির্ধারণ উচিৎ। পুরুষরা নফল নামায ঘরে পড়া উত্তম।(দুরুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ১৮১)
সুন্নাত ইতিকাফ অর্থাৎ রমজান শরীফে শেষ দশকে যে ইতিকাফ পালন করা হয় সেটাতে রোযা রাখা শর্ত। মুস্তাহাব ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নহে।
ইতিকাফ কারীর করণীয় আমল: ইতিকাফ পালন কালে চুপ থাকাবেনা কথাও বলবে না। কুরআন তিলাওয়াত করবেন, যিকর, তাসবীহ, তাহলীল পড়বেন, নফল নামায পড়বেন, হাদীস শরীফ পাঠ করবেন, অধিকহারে দরুদ শরীফ, দ্বীনি ইলম অর্জন করবে দ্বীনি শিক্ষার আলোচনা করবে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীদের (আলাইহিমুস সালাম)’র জীবনী গ্রন্থ আউলিয়ায়ে কেরাম ও মকবুল বান্দাদের ঘটনাবলী ও দ্বীন সম্পর্কে লিখিত বিষয়াদি পাঠ করবেন। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ১৮১)
যেসব কারণে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়: ১. শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হওয়া, মানবীয় প্রয়োজন যেমন মলমূত্র ত্যাগ করার ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে মসজিদের বাইরে গেলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
২. রোগী দেখা বা রোগীর সেবার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবেনা।
৩. ই’তিকাফকারী জানাযার সালাত আদায় করার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবেনা। (আলমগীরি ১ম খন্ড, ফতোয়ায়ে শামী, খন্ড:২)
৪. ই’তিকাফ অবস্থায় সঙ্গম, চুম্বন, স্পর্শ করা বা আলিঙ্গন, বীর্যপাত হোক বা না থেকে ই.তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৫. ই’তিকাফ অবস্থায় কোন মহিলার মাসিক হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে, ২য় খন্ড)
ই’তিকাফের সময় দুনিয়াবি যাবতীয় চিন্তা থেকে মুক্ত হতে হবে: পুরুষদের জন্য ঘরে ই’তিকাফ করার অনুমোদন নেই। ইতিকাফের বরকত ও উপকারিতা তখনই অর্জিত হবে যখন দুনিয়াবি চিন্তাধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বান্দা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিকটবর্তী হবেন। এমনকি অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছাড়া মোবাইলে কথা বলা থেকেও বিরত থাকবেন। ইতিকাফ অবস্থায় মোবাইল যদি সাথে রাখেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই জরুরী প্রয়োজনেই কেবল ব্যবহার করবে। নারীদের ক্ষেত্রে ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি অপরিহার্য। নফল রোযা রাখতে হলে যেমন স্ত্রীর জন্য স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন তেমনি ইতিকাফের জন্যও স্বামীর অনুমতি অপরিহার্য। একান্ত ওযর ছাড়া ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েজ নেই। যেমন ইতিকাফ কারী এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যার চিকিৎসা মসজিদ হতে বের হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য অথবা আগুন নেভানোর জন্য ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েজ।
ইতিকাফকারী মসজিদের ভেতরেই পানাহার করবে ও ঘুমাবে: ইতিকাফরত মসজিদে যদি জুমআ না হয়, তখন ইতিকাফকারী পাশ্ববর্তী যেই মসজিদে জুমআ অনুষ্ঠত হয় সেখানে গিয়ে জুমআ আদায় করবে, জুমআ আদায় করেই ইতিকাফের মসজিদে ফিরে আসবে। নফল ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা জরুরী নয়। অবশ্য ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা জরুরী। (বাদায়েউস সানায়ে, খন্ড: ২, পৃ: ১০৮–১০৯)
নফল ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত কোনো সময় নেই, সাধারণভাবে যে কোন সময় ইতিকাফ করা নফল। (মা’আরিফুস সুনান, খন্ড:৬, পৃ: ১৯১–১৯২)
কেউ যদি নিদ্দিষ্ট দিনের বা তারিখে ইতিকাফের মান্নত করে তাকে ঐ নিদ্দিষ্ট দিনে বা তারিখেই ইতিকাফ পালন করতে হবে। শরয়ী ওযর ব্যতীত তা আদায়ে বিলম্ব করা জায়েজ নয়। (বাহরুর রায়েক, খন্ড:২)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দিন ইতিকাফ করতেন। বর্ণনাকারী হযরত নাফি রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) আমাকে মসজিদের সেই স্থানটি দেখিয়েছেন। যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ করেছেন। (ইবনে মাযাহ)
হে আল্লাহ রমজানুল মুবারকে আমাদের ক্ষমা করুন, কুরআনের বরকত, রহমত ও নিয়ামত আমাদের নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবু তাহের
নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: রোযা কত প্রকার ও কি কি? জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: ইসলামী শরীয়তে মুজতাহিদ ফকীহ গণের বর্ণনা মতে রোজা পাঁচ প্রকার। ১. ফরজ, ২. ওয়াজিব, ৩. নফল, ৪. মাকরুহ তানযিহী, ৫. মাকরুহ তাহরীমি। ফরজ রোযা: যেমন রমজানের রোযা, ওয়াজিব রোযা, যেমন মান্নতের রোযা, নফল দু প্রকার। ১. নফলে মসনুন, ২. নফলে মুস্তাহাব, যেমন মহররমের দশ তারিখের রোযা, ও নয় তারিখের রোযা। প্রতি চান্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের রোযা, আরাফার দিবসের রোযা। সোমবার ও শুক্রবারের রোযা। শাওয়ালের ছয় রোযা, সওমে দাউদ অর্থাৎ একদিন রোযা রাখা একদিন বিরত থাকা। মাকরুহ তানযিহীর রোযা কেবল শনিবার দিন রোযা রাখা। মাকরুহে তাহরিমী: যেমন ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫, পৃ: ১২৫–১২৬, আলমগীরি, দুররুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার)