মানুষের দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহ ও যাপিতজীবনের সাথে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের প্রতিদিনকার কষ্ট, ঘাম-শ্রম ও মেধার পেছনে অভিষ্ট লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জন। আর এই লক্ষ্য অর্জনে নারী-পুরুষ সকলে সমভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থনীতিতে পুরুষের তুলনায় বহুক্ষেত্রে নারীর অবদান অনেক বেশি। গৃহস্থালী কাজ থেকে শুরু করে উৎপাদন শিল্পে নারীর ব্যয়িত মেধা ও শ্রম জাতীয় উন্নয়নে অনন্য ভুমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাংকের উইমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২১ ইনডেঙে বলা হয়েছে, উন্নয়নের ভালো সুফল পেতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর পূর্ণাঙ্গ অর্ন্তভুক্তি প্রয়োজন। সংসার ঘোচানো থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা পর্যন্ত নারীর সরব উপস্থিতি সভ্যতার ক্রমবিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। নারীর মেধা ও শ্রমের আর্থিক মূল্য আছে। নারীরা পরিবারের পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রজনন, সংসার ও আবাসকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, নারীর এই নীরব অবদানের অর্থমূল্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যা গত ২০১৭ সালের মোট জিডিপির ৭৮.৮ শতাংশ। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন একজন নারী একজন পুরুষের তুলনায় গড়ে প্রায় তিনগুণ এমন কাজ করেন যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণ’র জরিপ মতে, একবছরে পরিবারে নারীদের কাজের আর্থিক মূল্য ১ লাখ ১১ হাজার ৫৯১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৮ দশমিক ৬ লাখ। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোষাক শিল্পখাত থেকে আসে। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ বলছে, দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এই খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারীর ৭০ ভাগ। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময়ে মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। বর্তমানে প্রবাসে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রবাসী আয়ে নারীর অবদান অনন্য। তারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস’র (বেসিস) মতে, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এদের মধ্যে অর্ধেকই নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী। তারা মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানান, বিগত কয়েক বছরে ২১ জেলায় প্রায় সাড়ে দশ হাজার নারী উদ্যোক্তা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। গত এক দশকে দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫০ লাখ। ২০০৫-২০০৬ সালের শ্রমশক্তির জরিপ মতে, দেশের ১ কোটি ২০ লাখ নারীর প্রায় ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষিকাজ, পশুপালন, হাঁস-মুরগী পালন, মাছ-চাষ ইত্যাদিতে নিয়োজিত। কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। বিবিএসের ২০১৮ সালের তথ্যমতে, দেশের কৃষিখাতে নিয়োজিত আছে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। আইএলও শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ নারী কৃষি, মৎস্য-চাষ ও সামাজিক বনায়নের সাথে জড়িত। সিএসআরএলের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন মতে, কৃষিখাতে ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। চা-শিল্পে নারীর অবদান খুবই গুরত্বপূর্ণ। চা-বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী। প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে নারীর ৬০ শতাংশ কোটা অনেক আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্যমতে, সেবাখাতে কাজ করেন ৩৭ লাখ বা ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী। শিল্পখাতে কাজ করেন ৪০ লাখ ৯০ হাজার নারী। ২০২০ সালের নার্সিং ও মিডওয়াফারি অধিদপ্তরের পিএমআইএস তথ্যমতে, দেশে নারী নার্সের সংখ্যা ৯০ দশমিক ৬ শতাংশ। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন। প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী। চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী ও উচ্চপদে কর্মরত আছেন নারীরা। নির্বাহী ও উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। তাছাড়া নারীরা শিক্ষক, নির্মাণ কর্মী, বিজ্ঞানী, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, শিল্পী, গণমাধ্যম কর্মী ইত্যাদি পেশাকে বেছে নিচ্ছেন। বর্তমানে গৃহকর্ম পেশাকেও বেছে নিচ্ছেন অনেকে। বিবিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে ৯ লাখ নারী গৃহকর্মীর কাজ করছেন। বিনোদন ও শিল্পকর্মে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৯ হাজার নারী। ব্যাংক, বীমাসহ আর্থিক খাতে কাজ করেন ৭০ হাজার নারী। শিক্ষকতা পেশায় আছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ নারী। দেশের ৪২ হাজারের বেশি কলকারখানার মধ্যে ২ হাজার ১৭৭টি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ কারখানার মালিক নারী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের হিসাব মতে, কারখানায় ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর তথ্যমতে, দেশের ৫ হাজার ৮৬৫টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারী কাজ করছেন। শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ হার ৩২ শতাংশ। ভারতে এই হার মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ যা ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ২০২০ সালের গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এছাড়াও সংসারের বাইরের ও ভেতরের কাজের মূল্য ধরলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। যার মানে দাঁড়ায় দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী পুরুষের অবদান সমান সমান। মূলধারার অর্থনীতি উৎপাদন খাতে নারীর সংখ্যা ২২ লাখ ১৭ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাসহ নানা কাজে যুক্ত রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ২ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে যুক্ত হচ্ছেন। ১৫ বছরের বেশি ১০ কোটি ৯১ লাখ মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেক নারী হলেও কর্মবাজারে সক্রিয় আছেন ২ কোটি নারী। কর্মবাজারের বাইরে থাকা ৩ কোটির বেশি নারী কর্মবাজারে যুক্ত হলে দেশের মোট জিডিপিতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। যা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।