কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সাতবারেও জামিন পাননি ঝুমন দাশ
ঝুমন দাশকে মনে আছে? হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে আটক ঝুমন দাশ এখনো কারাগারে। সাতবারের চেষ্টায়ও জামিন পাননি ঝুমন৷ অথচ হিন্দুপল্লীতে হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার ৫২ জনের সবাই এখন জামিনে মুক্ত।
এ বছরের ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের গ্রামে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের অভিযোগ, ওই গ্রামের ঝুমন দাশ নামে একজন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে । অথচ হামলা বা সংঘাত এড়াতে তার একদিন আগে ১৬ মার্চই ঝুমন দাশকে পুলিশ হেফাজতে দেন তার গ্রামবাসীরা। সে সময় থানা পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপরও পরের দিন সকালে পুরো হিন্দুপল্লীতে পরিকল্পিত হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। হামলার ঘটনায় শাল্লা থানায় অজ্ঞাত পরিচয়সহ মোট দেড় হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের মধ্যে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সবাই এরইমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ঘটনার পাঁচ দিন পর পুলিশ হেফাজতে থাকা ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এখনো কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দেয়া হয়নি। ঝুমন দাশ জামিনও পাননি । তিনি পাঁচ মাস ধরে কারাগারে আছেন বলে জানান তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট দেবাংশু শেখর দাস।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “এ পর্যন্ত সাতবার জামিনের আবেদন করেছি। হাইকোর্টেও করেছি। কিন্তু জামিন হয়নি। হাইকোর্ট জামিন না দেয়ায় এখন আবার আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতে জামিন আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্ত শেষ হচেছ না, জামিনও পাচ্ছি না। মামলায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কটুক্তি করায় ধর্ম অবমামনার অভিযোগ আনা হয়েছে।’ মামুনুল হকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা ধর্ম অবমাননা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তো আইন আদালতের বিষয়। তবে ওই গ্রামে হামলা হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এর সাথে ধর্ম অবমাননার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করি।’ মামুনুল হক নিজেও এখন কারাগারে আছেন। নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় সারাদেশে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ইন্ধন দেওয়াসহ আরো কয়েকটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরে হেফাজতের নতুন কমিটি থেকেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। ঝুমন দাশের স্ত্রী এবং ১১ মাস বয়সের একটি কন্যা শিশু রয়েছে। ঝুমন দাশ কারাগারে থাকায় তারা নানা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। এ বিষয়ে ঝুমন দাশের স্ত্রী সুইটি রানী দাশ বলেন, “মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাতে ধমের্র অবমাননা হয় কীভাবে? সরকারেরও তো অনেক মন্ত্রী এমপি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাহলে তারাও তো অপরাধ করেছেন। তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হয় না? আমিও বলেছি, আমাকেও গ্রেপ্তার করা হোক।” তিনি আরও বলেন, ‘ যারা হামলা করলো তাদের সবাই জামিন পেয়ে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আমার স্বামী জামিন পান না। তাকে এখনো কারাগারে রাখা হয়েছে। এটা কেমন বিচার? কেমন আইন?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ মনে করেন, ‘আইনে ধর্ম অবমাননার কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এর অপব্যবহার হচ্ছে। হয়রানি বা অসৎ উদ্দেশ্যে আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে।’ ঝুমন দাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি তো একজন ব্যক্তির (মামুনুল হক) বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে ধর্মের অবমাননা হয় কীভাবে?’
৪ জুন ২০২১ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ ঝুমন দাশের মুক্তি চেয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তাঁরা বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা করার পর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ঝুমন দাশ আপনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। এ মামলায় ঝুমন দাশ দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন। ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে করা মামলায় সুনামগঞ্জ মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট জামিন না দেওয়ায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ঝুমন দাশের জামিনের আবেদন করা হয়। কিন্তু কয়েক দফা শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত ঝুমনের জামিন মঞ্জুর করেননি। যদিও ইতিমধ্যে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় করা মামলার আসামিদের অনেকেরই জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় কঠোরতার বিপরীতে ভুক্তভোগীর প্রতিই রাষ্ট্রের কঠোরতা দৃশ্যমান। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, একই সঙ্গে সংবিধান পরিপন্থী।
বিবৃতিতে বলা হয়, শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। এর আগেও কঙবাজারের রামুর বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বসতিতে, যশোরের মালোপাড়া, ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া-কর্ণাই, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের পাগলাপীর, ভোলার বোরহানউদ্দিন, কুমিল্লার মুরাদনগরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে কটাক্ষ করে পোস্ট দিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সামপ্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, সামপ্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে বেড়ানো ও সামাজিক সংহতি বিনষ্টকারী সংগঠন হেফাজত ইসলামকে সমীহ করতে গিয়ে রাষ্ট্র ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে।’ বিবৃতিদাতারা ঝুমন দাশসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা সবার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সুলতানা কামাল, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ডা. সারওয়ার আলী, রামেন্দু মজুমদার, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, এস এম এ সবুর, রানা দাশ গুপ্ত, জাহিদুল বারী, নুর মোহাম্মদ তালুকদার, খুশী কবির, রোকেয়া কবির, এম এম আকাশ, রোবায়েত ফেরদৌস, সালেহ আহমেদ, মো. জাহাঙ্গীর, পারভেজ হাসেম, মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, দীপায়ন খীসা, জীবনানন্দ জয়ন্ত, সেলু বাসিত, অলক দাস গুপ্ত, এ কে আজাদ ও গৌতম শীল।
আমরা মনে করার চেষ্টা করি, ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রায় নয় বছর পার হলেও কোন বিচার এখনও হয়নি। এই ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছিল। একটি মামলার চার্জশিট হলেও বিচার শুরু হয়নি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো তারা সবাই জামিনে আছেন। আর যে উত্তম বড়ুয়ার নামে ফেসবুক পোস্টের অজুহাতে রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল তিনি জামিন পেলেও এখন নিখোঁজ রয়েছেন। যদিও তদন্তে তার ফেসবুক পোস্টের কোনো প্রমাণ মেলেনি। এরপর, ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলার তদন্ত প্রায় পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। ওই সময় যাদের আটক করা হয়েছিল তারাও জামিনে মুক্ত। অন্যদিকে লেখাপড়া না জানা যে রসরাজের ফেসবুক পোস্টের ধর্মীয় অবমাননার কথা তুলে হামলা হয়েছিল তাকেই উল্টো দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। এখন জামিন পেলেও তিনি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
একইভাবে রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তদন্ত শেষ হয়নি। হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা কাজল দেবনাথ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের জানামতে গত কয়েক বছরে কোনো হামলারই বিচার হয়নি। প্রত্যেকটি হামলার পেছনেই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহারকারী নেপথ্যের শক্তি রয়েছে। তাদের পরিকল্পনায়ই এইসব হামলা হয়েছে।’
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত বছরের অক্টোবরে সাতমাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি জরিপ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর এই সাত মাসে ৬০টি পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ২৩টি ঘটনা ঘটেছে। ওই সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ১৭ জন সংখ্যালঘু। হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ১১ জনকে। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০ জন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৩ জন। ২৭টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। বসতভিটা, জমিজমা, শ্মশান থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। তাদের হিসাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক ঘটনায় মামলাও করা যায় না। আর বিচার পাওয়ার হার সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। কাজল দেবনাথ বলেন, ‘’এতদিন ছিলো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা। আর সুনামঞ্জের ঘটনায় দেখা গেলো হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করায় হামলা। এর সাথে ধর্ম অবমাননার কী সম্পর্ক আছে? আর মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন।’
এটি ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিকর বা মর্যাদাকর কোনো আলামত নয়। বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে দেশ শাসন করছে। বিশ্বের অন্যতম সফল নেতাশেখ হাসিনা। দেশের সকল ধমের্র, সকল বণের্র মানুষের ভরসা ও আস্থার নাম শেখ হাসিনা। কাজেই আমরা প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে চাই এ দেশে কোনো মানুষ ধর্ম-গোত্র-ভাষা-সংস্কৃতি-বর্ণের জন্য নিগৃহীত হবে না। সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে রাষ্ট্রকে তাঁর আদর্শ ও নীতির পথেই চলতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে জাতির পিতাকেই অপমান করা হবে। লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম