জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম সহচর এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের প্রধান নেতৃত্বে থাকা মহান ব্যক্তির নাম জহুর আহমদ চৌধুরী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বীর চট্টলার সূর্য সন্তান বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন রাজনীতির পরিপক্ক জহুরী। তিনি রাজনীতি বুঝতেন, জানতেন। তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজনীতিতে। রাজনীতিও তাঁকে উজাড় করে দিয়েছিলো। তাঁর কোনো পিছুটান ছিল না। যেমন পকেট হাতড়ে দেখতেন টাকা–পয়সা আছে কিনা। থাকলে সে টাকা কিভাবে অন্যকে দিয়ে পকেট খালি করবেন সেজন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাজনীতিও যখন করতেন, সামনেরটাই দেখতেন, পেছনটা দেখতেন না। কারণ পেছনে তো তাঁর কিছু নেই। না কোনো বন্ধন, না কোনো সঞ্চয়। তিনি ছিলেন বর্তমানপন্থী, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে উদ্বেগাকূল হতেন না। তাই ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চিত রাখতেন না, সঞ্চিত শুধু তাঁর নানা অবদান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে একনিষ্ঠভাবে দেশ মাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে জীবন–জীবিকার সকল ঝুঁকির বিনিময়ে তিনি অকাতরে নিজেকে নিযুক্ত করেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনাসহ চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ত্বরিৎ গতিতে পি.জি. হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক মানের চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ছিল চট্টলপ্রেমিক মানুষটির আজন্ম স্বপ্ন। চট্টগ্রামে ফয়’স লেকস্থ চক্ষু হাসপাতাল তাঁরই অবদান। তিনিই ছিলেন অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও প্রধান কাণ্ডারী। গুরুত্বপূর্ণ চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপালনকালে বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন। সেই সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হন পশ্চিম জার্মানির আন্দেরি হিলফি নামের একটি মানবিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট রোজি গোলম্যান। জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে ফয়’স লেকে রেলওয়ে থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তায় বর্তমান চক্ষু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশকে বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে লাখো মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে। চোখের চিকিৎসায় শুধু চট্টগ্রামেই নয়, পুরো দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আজ দেশের অগণিত মানুষের চোখের চিকিৎসায় আস্থার নাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যার স্থানীয় নাম পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল।
হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠায় চট্টলদরদী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর অবদান আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে কুখ্যাত সেনা–স্বৈর শাসকদের রাজত্ব কায়েম হয়। এ সময়ে কূট পরিকল্পনায় প্রয়াত জহুর আহমদ চৌধুরীর অবদানকে আড়াল করে কেউ কেউ নিজেদের তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা বা সমাজ সেবকের মুখোশ ধারণ করে। নানা জনশ্রুতি ও তথ্য–উপাত্ত উদ্ঘাটনে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, একটি আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে ২৪ মার্চ ১৯৭৩ ইং মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে জহুর আহমদ চৌধুরী বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রামের একটি এডহক কমিটি গঠন করেন। অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে মূল দলিল গায়েব করা হলেও; বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার নিকট সংরক্ষিত নথিপত্র অনুসারে তৎকালীন দেশের প্রধান শিল্পপতি এ. কে. খান সাহেবকে প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: এস জোহা, খ্যাতিমান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: এ. কে. এম. আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক সমাজসেবা অধিদপ্তরকে সহ–সভাপতি, বন্দর হাসপাতালের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডা: কামাল এ. খান ও বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: এস. আর. দাশকে যুগ্ম সম্পাদক, এলিট পেইন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজ উদ্দিন আহমদ সাহেবকে কোষাধ্যক্ষ এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান ১৮ ব্যক্তিদের সদস্য করে এডহক কমিটি গঠন করেন। একজন প্রবীণ নাগরিক, রাজনীতিবিদ ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে নব প্রজন্মের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি ।
উল্লেখ্য যে, এখনো জীবিত প্রাচীন সদস্য ও চক্ষু হাসপাতালের প্রাক্তন কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকের অভিমতে এই সত্যটুকু প্রতিষ্ঠিত যে, জহুর আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু সরকারের সম্মানিত মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীত্বের ক্ষমতাবলে প্রথম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্থ জেনারেল হাসপাতালের দুটি রুম বরাদ্দ দিয়ে চক্ষু হাসপাতালের যাত্রা শুরু করেন। তাদের মতে, তারা এটুকু জেনেছেন যে সরকারি কোষাগার থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী উক্ত হাসপাতালের ব্যয় মিটানোর জন্য সম্ভবত ৬০ হাজারের অধিক পরিমাণ টাকার চেক প্রদান করেন। বর্তমান বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চৌকস একটি তদন্ত দল গঠন করে পুরো বিষয়টিকে আমলে নিলে দেশের ইতিহাস বিকৃতির মত সেনা শাসকদের পোষ্যরা কীভাবে জহুর আহমদ চৌধুরীকে অদৃশ্য করে বিএনএসবি ও চক্ষু হাসপাতালকে নিজেদের নামে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তার সত্যতা নিরূপণ করা যাবে। অত্যন্ত জঘন্যতম বিষয় হচ্ছে এই, চক্ষু হাসপাতালের অফিস রুমের মূল ফটকে দুজন সেনা শাসকের বিশাল নামফলক এখনও শোভিত রয়েছে। অথচ এর পিছনে মূল কারিগর বা প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কোনো স্মৃতিচিহ্ন কোথাও সংরক্ষিত নেই। সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে পরিবারকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে ১৯৭৫ এর পর থেকে চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালকে ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে দখলে নিয়ে নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত করা হচ্ছে।
জহুর আহমদ চৌধুরীর স্বীকৃতি শুধু নয়; বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সূচনা থেকে এ পর্যন্ত সকল কিছু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জরুরি বিচার বিশ্লেষণে ব্যর্থ হলে হাসপাতালটি বিশেষ ব্যক্তি ও পরিবারের পুরোপুরি কুক্ষিগত হয়ে পড়বে।
স্মরণযোগ্য যে, জহুর আহমদ চৌধুরী ১৯১৬ সালে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় ও পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলে পড়াশোনা করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ১৯৪০ সালে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয় এবং ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনসহ বহু আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রাথী হিসেবে জহুর আহমদ চৌধুরী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়, তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। এ সময় অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্ব ছিল অসীম সাহসিক ও দুর্জেয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীটি ওয়ার্লেস বার্তার মাধ্যমে প্রেরণ করা হয় জহুর আহমদ চৌধুরী বরাবরে। যা তিনি পরক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের মাধ্যমে বেতারযোগে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন এবং ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রথম ভাষণ দেন জহুর আহমদ চৌধুরী। তিনি ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে কোতোয়ালী–পাঁচলাইশ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি আমৃত্যু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জানাজা শেষে দামপাড়াস্থ পারিবারিক কবরস্থানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। অত্যন্ত হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র জনৈক ব্যক্তির নাম এককভাবে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানে তাঁর নাম ও ছবি টাঙ্গানো নেই। আশাকরি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এ–মহান রাজনীতিবিদকে যথাযথভাবে তাঁর অবদান ও কর্মের স্বীকৃতি দান করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সকল সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালটি ‘জহুর আহমদ চৌধুরী চক্ষু হাসপাতাল’ নামাকরণ করে এই মহান ব্যক্তির অবদান ও স্মৃতিকে অম্লান করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। দেশ ও চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এ দাবিটি উপস্থাপন করে ভবিষ্যতেও এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত লেখার আশা পোষণ করছি।
তথ্যসূত্র :
১. বাবার কথা, লেখক : হেলাল উদ্দীন চৌধুরী তুফান, (গণ মানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী)।
২. খাঁটি দেশপ্রেমিক, লেখক নেছার আহমদ।
৩. জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ, একুশে টেলিভিশন, প্রকাশিত : ১২:০০, ১ জুলাই ২০২০।
৪. গণমানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, নেছার আহমদ, প্রকাশিত দৈনিক আজাদী বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২।
৫. স্মরণ : জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, প্রকাশিত : সুপ্রভাত, শুক্রবার, জুন ২৪, ২০২২।
৬. চৌধুরী জহুর আহমদ, বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ, প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০১৪।
৭. উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ।
লেখক ঃ প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী, সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি, চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশন, সিনিয়র এডভোকেট ও রাজনীতিক, সহ–সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।