চট্টগ্রামকে জ্বালানি তেলের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চায় পৃথিবীর শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবের আরামকো। চট্টগ্রামে জ্বালানি তেলের রিফাইনারি স্থাপনের ব্যাপারে তারা আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনবার ফিরে যাওয়ার পর আবারো তাদের এই প্রত্যাবর্তনকে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। অ্যারাবিয়ান আমেরিকা অয়েল কোম্পানি (আরামকো) চট্টগ্রাম থেকে চীন, ভারতসহ পূর্ব–দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে তেল রপ্তানি করতে চায়। একইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে তারা সৌদি আরবের জেদ্দার সাথে একটি সমুদ্র রুটও গড়ে তোলার আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশ্বের এক দশমাংশ জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটানো আরামকো চট্টগ্রামে আসলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরামকো দৈনিক ৯০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। যা বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ। সৌদি আরব এবং আমেরিকার যৌথ এই কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল। ১ লাখ ৩৬ হাজার লোকবল নিয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ এই কোম্পানি পৃথিবীর জ্বালানি তেলের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। মধ্যপ্রাচ্য, ফিলিপাইন এবং কোরিয়া, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তেল ও গ্যাস সেক্টরে আরামকোর বিনিয়োগ রয়েছে। বিশ্বখ্যাত এই কোম্পানি বাংলাদেশে রিফাইনারি স্থাপনসহ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন দফায় ঢাকায় এসেছিল। কিন্তু তাদের প্রস্তাব বিবেচনা না করে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সৌদি দূতাবাসের সাথে ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী জানান, আরামকোর প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নিচের দিকে নামলেই গতি হারিয়ে ফেলতো। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গেলে আটকে যেত। ব্যক্তি স্বার্থে এসব প্রকল্প আটকে ফেলা হতো বলে উল্লেখ করে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, আরামকোকে কেউ বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেনি, উল্টো প্রতিনিধিদলকে হতাশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী বলেন, দফায় দফায় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলেও তারা আশা ছাড়েনি। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবারো তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এই সরকারের ব্যাপারে তারা বেশ আশাবাদী বলে উল্লেখ করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আরামকো চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে একটি রিফাইনারি স্থাপন করে এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে চায়। এতে তাদের যেমন বড় ধরনের ব্যবসার সুযোগ রয়েছে তেমনি আমাদেরও স্বার্থ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যবসায়ী বলেন, সৌদি আরবে আমাদের ৩০ লাখের মতো মানুষ কাজ করে। দেশটির সাথে আমাদের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্ক শুধু জনশক্তি রপ্তানিতে সীমাবদ্ধ না রেখে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমপ্রসারণ করা গেলে আমরাই বেশি উপকৃত হবো।
ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানকে উদ্ধৃত করে চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী বলেন, আরামকো চট্টগ্রামে তেল রিফাইনারি কারখানা প্রতিষ্ঠা করে পূর্ব–দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে তেল রপ্তানি করতে চায়। চট্টগ্রামকে তারা গড়ে তুলতে চায় তেল রপ্তানির হাব হিসেবে।
শুধু জনশক্তি রপ্তানিই নয়, সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের পাঁচ দশকের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে অপর একটি সূত্র বলেছে, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত অর্থবছরে ২.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সৌদি আরব একটি বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ৫৩৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং ১০৬.৩৮ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করেছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকসহ নানা পণ্য রপ্তানি করে সৌদি আরবে। অপরদিকে সৌদি আরব থেকে জ্বালানি তেল, সার এবং কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে। চট্টগ্রাম বন্দরেও সৌদি আরবের বিনিয়োগ রয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতা মাহফুজুল হক শাহ গতকাল দৈনিক আজাদীকে সৌদি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বলেন, আরামকো সৌদি আরব এবং আমেরিকার যৌথ কোম্পানি। এটি বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারী কোম্পানি। আরামকোর প্রস্তাব গ্রহণ করে তাদের যত দ্রুত সম্ভব এখানে রিফাইনারি স্থাপনে উৎসাহিত করা দরকার। তিনি বলেন, আমাদের বার্ষিক জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। আমাদের রিফাইনারির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন। বাকি ৬০ লাখ টনেরও বেশি রিফাইন্ড অয়েল আমাদের আমদানি করতে হয়। আরামকো এখানে রিফাইনারি স্থাপন করলে এই খাতে আমাদের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
তিনি বলেন, বিগত সরকার তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ভুল করেছে। ওই ভুল আর করা যাবে না। বিনিয়োগ রুটের বহু ট্রেনই আমরা মিস করেছি। এখন আর মিস করার সুযোগ নেই। যত দ্রুত আমরা ট্রেন ধরতে পারবো তত তাড়াতাড়ি আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। তিনি শুধু সৌদি আরবই নয়, দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে যে কোনো বিনিয়োগকে টেনে আনা দরকার বলেও মন্তব্য করেন।