বিশ্বের বিভিন্ন শহর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত হয়েছে। বাণিজ্য, পর্যটন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প এমনকি সম্মেলনের কারণেও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বহু শহর। তবে অনেক শহর আছে যেগুলো শুধু সাহিত্যের জন্য বা বিভিন্ন বইপত্রের জন্য বিখ্যাত হয়েছে। আবার বই অনেক শহরকে প্রসিদ্ধ করেছে। বইয়ের কারণেই অনেক শহর বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাচীন বা মধ্যযুগের মতোই আজকের এই অতি আধুনিক বিশ্বেও বইয়ের কারণে বিখ্যাত হয়েছে অসংখ্য শহর। কিন্তু পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থ বা বইটি কোন শহর থেকে প্রকাশ পেয়েছিল। সে তথ্যটি অনেকেরই অজানা।
হায়ারোগ্লিফ মিশরীয় সভ্যতায় দেখা যায় যে, চিত্র কেন্দ্রিক লিপিমালা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Hieros। অর্থাৎ পবিত্র এবং Glyphein অর্থাৎ খোদাই। কোনো চিন্তার প্রতিরূপ হিসেবে এক একটি ছবি আঁকত। এই ছবি একে কয়েকটি শব্দ প্রকাশ করা হয়। এই রকম সাত’শ বিভিন্ন শব্দের সমারহে গঠিত এ ভাষা। আসলে বই কী? এবং বই কীভাবে উৎপত্তি হয়। তবে লেখার উপকরণ ‘পাতা’ বা ‘পত্রাঙ্ক’ কথাটির থেকে উৎপত্তি আর লিখিত পত্রপুঞ্জ এক সঙ্গে গাঁথা হয় বলে এর নাম গ্রন্থ বা বই। বই শব্দটি এসেছে আরবি ‘বহী’ থেকে। যার অর্থ দৈব অনুজ্ঞা আর ‘পুস্তক’ কথাটির মূলে রয়েছে পারসিক ‘পুস্ত’ (Pust)। অর্থাৎ চামড়া থেকে উৎপন্ন। তবে সঠিকভাবে সজ্ঞায়িত করলে বুঝায় যায় যে, বই কথাটি এসেছে আরবি শব্দ ‘বহী’ থেকে। Book এর পূর্ণরূপ হলো Bio Optical Organized Knowledge । সুমেরীয়, অ্যাসরীয় ও ব্যালিনীয় যুগে প্রচুর মাটির চাকতির গ্রন্থ পুরাতাত্ত্বিকদের আবিষ্কার। তারপরে আসিরীয় রাজা অসুরবানিপালের নিনেভের গ্রন্থের জোড়া প্রচুর চাকতির গ্রন্থ পাওয়া যায়। মাটির ফলকের লেখা আদি যুগের গ্রন্থ, প্যাপিরাসের বা তালপাতায় লেখা বইয়ের যুগ এবং যান্ত্রিক ছাপাখানায় লক্ষ লক্ষ কপি বইয়ের পর্যায় পেরিয়ে তাবৎ পৃথিবী এখন প্রবেশ করেছে ডিজিটাল যুগের ই-বইয়ের জগতে। এখন মানুষের হাতের মুঠোয়-ধরা মোবাইল ফোনের ভেতরে স্থান পেয়েছে। যে কোনো জায়গা থেকে ইন্টারনেটের সুবাদে পৃথিবীর প্রধান প্রধান গ্রন্থাগারগুলোর বইপত্র পাঠ করাও এখন আর অসম্ভব কিছু নয়। এমন প্রেক্ষাপটে গ্রন্থের উদ্ভব ও বিকাশ ঃ একটি পর্যালোচনা আসলেই একটি রোমাঞ্চকর বিষয়।
গ্রন্থের উদ্ভব ও বিকাশ
ল্যাটিন ভাষায় এ গ্রন্থের নাম ছিল কোডেক্স (Codex )। যার নাম থেকে এসেছে কোড (Code )। কথাটি গ্রিস ও রোমের প্রবর্তিত লেখার কায়দা ও বর্ণমালা পদ্ধতি সভ্য জগতে বিশেষ দান। ক্লদিয়রা (Chaldes ) গাছের ছালকে বলা হতো খরনবৎ এবং এ থেকে লাতিন লিবর (Libre )। যার মানে ‘বই’ বা ‘গ্রন্থ’। কিন্তু আসলে গ্রন্থ বা বই কী? বই হচ্ছে মানুষের দেখা ও জানা বা অভিজ্ঞতার লিখিত দলিল। যুগ থেকে যুগান্তর মানুষের জ্ঞান ও তার কর্ম কীর্তিকে পৌঁছাবার কাজে কথ্য ভাষা অপারগ ছিল। তাই আজ থেকে বিশ বা ত্রিশ হাজার বছর পূর্বে প্রস্তর যুগের মানুষ গুহায় অংকন করে এবং পাহাড়ের গাইয়ে খোদাই করে তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার কথা অপর যুগের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানী বলেন, ‘A Collection of books assemble for use, as against collections assembled for sale, for display, for the pride of possession or for any of the purposes for which books may be assembled.’
উপরি উক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য মূলত গ্রন্থ আবিষ্কার করা হয়েছে। তাই প্রথম বইয়ের সন্ধান কীভাবে আসে আধুনিক কালের যুগান্তরকারী আবিষ্কার হলো সচল হরফ (Movable type )। প্রতিটি হরফ স্বতন্ত্রভাবে খোঁদাই করে সাজিয়ে সাজিয়ে ছাপানো হয়। এ পদ্ধতির আবিষ্কারক হিসেবে জার্মানির যোহান গুটেনবার্গ এবং হল্যান্ডের লরেন্স কষ্টার এর নাম যুক্ত রয়েছে। বইয়ের কখন সন্ধান পায় বা কবে কীভাবে তা বিবরণ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গুটেনবার্গ জার্মানির মাইনজ শহরে এটি চালু করেন। তাঁর মুদ্রিত ‘বিয়াল্লিশ বাইবেলই বিখ্যাত’ ছিল। ১৪৭৭ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম মুদ্রাকার William Caxton তাঁর প্রথম বই প্রকাশ পায়। একটি সূত্রে থেকে জানা যায় যে, ১৫৫৬ সালে ভারতবর্ষে পর্তুগিজ মিশনারিরা গোয়াতে প্রথম ছাপাখানা চালু করেন এবং ১৫৫৭ সালে জন দ্য বুস্টামেন্ট ছাপান দট্রিনা ক্রাইস্টা প্রকাশ করেন।
১৫৭৭ সালে ত্রিচুরে প্রথম হরফ তৈরি করেন এবং ১৭১১ সালে বাইবেলের তামিল অনুবাদ ছাপা হয়। এ সময়ে মাদ্রাজের ট্রেকোয়ারার শহরে বসে প্রথম কাগজ কল তৈরি করেন। তবে এর আগে ভীমজি পারেখের চেষ্টায় ১৬৭৪ সালে বোম্বাই শহরে প্রথম যন্ত্র চালু করেন। ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় এবং প্রকাশিত নাথানিয়েল ব্রাসি হালহেদ রচিত ‘এ গ্রামার অব বেঙ্গলি লেগুয়েজ্থ অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় লেখা এ বইয়ের উদ্ধতিগুলি বাংলা হরফে ছিল। এ হরফ তৈরি করেন জন উইলকিন্স-যাঁর সহকারী ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। অবশ্য এ সময়ে লন্ডনে বসে উইলিয়াম বোল্টস বাংলা হরফের ছাঁচ তৈরি করেন। এ হরফ উইলিয়ামের তত্ত্বাবধানের কলকাতার কোম্পানি প্রেস থেকে ছাপা হয়। এর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা বই হলো জোনাথন ডানকানের ‘ইম্পেকোড’ এবং এর বঙ্গানুবাদ English Book থেকে প্রকাশ করা হয়। যা পত্রিকা কেন্দ্রিক কিছু ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছে এবং যা ক্রমিকল প্রেসটি থেকে মুদ্রিত। ১৭৯৩ সালে প্রথম ইংরেজি বাংলা বিধান ইংরেজিও বাঙ্গালী বোকেবিলারি প্রকাশিত হয়। এছাড়াও বই আবিষ্কারের কিছু বিবরণ নিম্নে বর্ণিত হলো-
বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত ও বাংলা হরফকে মর্যাদা প্রদান করেন ‘উইলিয়াম কেরী’। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুর মিশনারি প্রেস থেকে বাংলা বাইবেল ছাপানো হয়।
উইলকিন্স এর সহকারী পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাতা মনোহর এ দক্ষ ০২ কারিগরিকদের উদ্যোগে হাতে বাংলা হরফের ছাঁচ ঢালাই করে হলফ তৈরি করেন।
১৮৩২ সালের মধ্যে কেরী সাহেব ‘দু’ লক্ষ বারো হাজার বই ছাপানো হয়। কেননা এর মধ্যে ১৭৭৯ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়েছে। শ্রীরামপুর মিশন থেকে তাঁর প্রয়োজনীয় সকল বই লিখিত প্রকাশ পায়। প্রাথমিকভাবে গ্রন্থবিদ্যা থেকে গ্রন্থের ধারণা এসেছে। কারণ গ্রন্থবিদ্যা কথাটির ইংরেজি Bibliography। এ থেকে গ্রন্থের ধারণার একাধিক অর্থবোধক। যার অর্থ ছিল ‘গ্রন্থ’ এবং লেখা কিছু কাল পরে অর্থ বদলে দাঁড়ায় গ্রন্থ নকল করা। অর্থাৎ লিপিকারের কাজ এবং শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় গ্রন্থ সম্বন্ধে লেখা বা বিবরণ। লিপি কৌশল আয়ত্ব করার পর মানুষ আবিষ্কার করেন মুদ্রণ বা ছাপার কৌশল। যার ফলশ্রুতিতে তৈরি করেন মুদ্রণ যন্ত্র। আর তখন থেকেই কাগজ খণ্ডকে একত্রিত করে বই আকারে বাঁধা হয়। যেহেতু খোঁদাই যুক্ত কাঠ খণ্ডকে বলা হয় ব্লক। তাই কাঠ খোঁদাই এর সাহায্যে ছাপা বইয়ের নামকরণ হয়েছে ব্লক বই। ব্লক বইয়ের প্রথম নিদর্শন চীন থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম ব্লক বই হলো Biblia pauperum (Poor Man’s Bible)| অর্থাৎ দরিদ্রের বাইবেল। দ্বিতীয় শ্রেণির ব্লক বইয়ের এক পৃষ্ঠায় রয়েছে ছবি এবং অন্য পৃষ্ঠায় রয়েছে ছবির ব্যাখ্যা। তার বিশেষ অবদান হলো অৎং Momorndi । যার অর্থ এ শ্রেণির একখানি ব্লক বই। এইভাবে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে চতুর্থ পর্যায়ের ব্লক বইয়ের পরে গুটেনবার্গের ছাপাখানায় ছোট বড় বই ছাপা হয়।
বিশেষ করে প্রাচীন বা মধ্যযুগে বইয়ের কোনো বাজার ছিল না। ইউরোপীয় দেশেও তেমনিটি পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী নকল করে দেওয়া হতো। তবে বই বিভিন্ন স্টেশনারি দোকানে পাওয়া যেত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এ সমস্ত স্টেশনারি দোকান সংযুক্ত থাকতো এবং সেখানে নকল নবীশের দলও নিযুক্ত থাকতো। উপরি উক্ত বিষয়টি ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যায়তন কর্মী সম্পর্কে লিব্রেয়ার ব্যক্ত করেন। ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্রের পরিচিতি লাভ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে লিব্রেরী ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনস্থ স্টেশনারি বইয়ের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পট-পরিবর্তনের ফলে মুদ্রণের অগ্রগতির কারণে নকল নবীশের চাহিদা কমে যায়। ফলে বইয়ের বিচারক কেবলমাত্র রাজা বা পণ্ডিত এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যুগের কারণে প্রকাশক, বিক্রেতা, পাঠক, সমালোচক ও সাহিত্যবিদ বই রচনাই মূল লক্ষ্য ছিল। তাই যুগে যুগে মানুষ তাঁদের স্বীকৃতি দিচ্ছে বই অধ্যয়নের মাধ্যমে।
লেখক: গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম।