ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান | শুক্রবার , ২৬ জুলাই, ২০২৪ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ প্রাপ্ত ক্ষণজন্মাদের একজন। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ মেধা ও প্রতিভা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা আরম্ভ করার পূর্বেই তিনি পৈতৃক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেও তাঁর মেধা, শ্রম, অধ্যবসায়, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদর্শিতা বলে জীবনের এক পর্যায়ে তিনি এক বিশেষ গুণধর ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় আসীন হন। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে যেতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অগণিত অবদানের মাঝে অমর, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। উল্লেখ্য, তাঁর ওইসব গুণের সাথে সংযুক্ত হয়েছে তাঁর প্রতি আপন মুর্শিদ ও গাউসে যমানের কৃপাদৃষ্টি, যা তাঁর জীবনে এনে দেয় অকল্পনীয় পূর্ণতা।

১৯২২ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৭৪ হিজরির ১৯ মহররম আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলক্বাদেরী বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈতৃক ক্ষুদ্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিত সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্য তৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে খ্যাত হন। তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবীদাওয়া আদায়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জন দরদী, প্রসিদ্ধ সমাজ সেবকও। তিনি জমিয়তুল ফালাহ্‌ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নরস্‌ এর সদস্য ও হজ্জ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। সুতরাং তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুলজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়ার প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্‌রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন এবং এগুলোর আজীবন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বর্তমানে সারাদেশে শতাধিক মাদ্‌রাসার পরিচালনাকারী আধ্যাত্মিক সংগঠন,আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আজীবন সহসভাপতি ছিলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী। তিনি স্বউদ্যোগে যে জ্ঞানভান্ডার আয়ত্ব করেছিলেন তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর কথাবার্তা, বক্তব্য ও যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

তিনি ছিলেন ফানাফিশ শায়খ

তিনি উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদই রসূল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি (ওরফে হযরত পেশোয়ারী সাহেব) আলায়হির রাহমাহ্‌র হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্‌ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। ইতোমধ্যে তিনি শরীয়ত, ত্বরীকত, বিশেষত আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন।

সিলসিলাহ্‌ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এতে যে, তাঁর মহান মুর্শিদের সুযোগ্য উত্তরসূরী মাদারাযাদ ওলী মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তা’আলা আলাইহি) তাঁকে খিলাফতের মহা মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদে বরহক্বের আনুগত্য তথা ত্বরীকত জগতের এক অনন্য উদাহরণ। আন্‌জুমানের তিনি সর্বপ্রথম সহসভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ এক তলা খানক্বাহ্‌ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন ও নিজ খরচে পরিচালনা করেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি আপন মহান মুর্শিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার এমন পরামর্শ সভায় বাঁশবেড়া ও টিনের ছাউনী কিংবা সেমি পাকা ঘর তৈরীর প্রস্তাবাবলী উপস্থাপিত হলে হুযূর ক্বেবলা তাতে রাজি হননি। হুযূর ক্বেবলার ইচ্ছা যে প্রথম থেকেই জামেয়া একটি মনোরম পাকা দালানেই প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সাথে সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামেয়ার জন্য পাকা দালানই হবে আর যাবতীয় রডসিমেন্ট তিনিই প্রদান করবেন। এতে হুযুর কেবলা অত্যন্ত খুশী হন এবং বিশেষভাবে দোয়া করেন।

এভাবে জামেয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আর আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আজীবন জামেয়াআন্‌জুমানের সর্বোচ্চ খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। মোটকথা হুজুর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া (ঢাকা)’র প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রর্বতিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’ বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন। তিনি সকলের নিকট শুধু শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না বরং সকলের হৃদয়ে অকৃত্রিম ভালবাসার স্থানও করে নিয়েছিলেন, যা তাঁর ইন্‌তিকালের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো।

আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী ১৯৭৯ ইং সাল মোতাবেক ১৪০০ হিজরির ১৯ মহররম ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জানাযা নামাযের পর তাঁকে জামেয়ার পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। এখানে তাঁর মনোরম সমাধি রয়েছে যাতে অগণিত মুসলমান নিয়মিত যিয়ারত করে ধন্য হন।

তাঁরই পদাঙ্ক অনুসারী পুণ্যবান উত্তরসূরীগণ

তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যগণ, বিশেষত তাঁর উত্তরসূরী সন্তানগণ এবং আত্মীয়স্বজনকেও হুযূর ক্বেবলার সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন এবং সিল্‌সিলার পুন্যময় কর্মকাণ্ডে রত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকাহ্‌ শরীফ ও সিলসিলার কর্মকান্ড পরিচালনা এবং জামেয়া আন্‌জুমান ও সুন্নী মতাদর্শের জন্য তার উত্তসূরীদের বিভিন্নভাবে অসাধারণ অবদান রাখার মধ্য দিয়ে এ সত্যটা উদ্ভাসিত হয়। তিনি আজীবন আন্‌জুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এর সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য সন্তান আলহাজ মুহাম্মদ মহসিন সাহেবকে হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরীরই পদে সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। নিয়োগপ্রাপ্তি থেকে আজ অবধি আলহাজ্‌ মুহাম্মদ মহসিন সাহেব ওই পদে সসম্মানে আসীন রয়ে জামেয়া, আন্‌জুমান, আলমগীর খানকাহ শরীফ্‌, বলুয়ার দীঘিস্থ খানক্বাহ্‌ শরীফ ও সিল্‌সিলাহ্‌ আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটির ব্যাপক কর্মকান্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছেন।

লেখক: মহাপরিচালকআনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক
পরবর্তী নিবন্ধড. মাহবুবুল হক : উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের চিরবিদায়