কানু শাহ্‌’র জীবন ও সাহিত্য

শাহাজাদা আব্দুল কাদের চাঁন্দ মিয়া | বুধবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সাগর মেঘলা গিরি কুন্তলা প্রাচ্যের রানির অন্যতম সুন্দর নগরী প্রাকৃতিক শান্ত নিবিড় মধুর পরিবেশে পাহাড় বনানীর এমন একলীলা নিকেতন চট্টলা আবহমানকাল থেকে কবি সাহিত্যিক দার্শনীক বৈজ্ঞানিক পীর সাধক আউলিয়ায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত আকর্ষণীয় কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার ৯নং পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন গ্রামে ক্ষণজন্মা এমন একজন কবি সাহিত্যিক ও সুফি সাধক শাহ্‌ আলী রজা কানু শাহ (রহ🙂 ১৭৫৯ ইংরেজি মোতাবেক ১৭ শ্রাবণ ১১৬৫ বাংলা ১০ রবিউস সানি ১১৫৯ হিজরি সোমবার সোবহ্‌ সাদেকের সময় তশরিফ আনেন। এই মনীষী ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর ছিদ্দীক (রহ🙂 এর বংশধর। শিশু হযরত আলী রজা (রহ🙂 পিতা মাতার তত্ত্বাবধানে তৎকালীন ধর্মীয় প্রথানুসারে তার পিতামাতার সান্নিধ্যে থেকে ৭ বছর বয়সে নামাজ রোজা কুরআন শিক্ষা মাছায়েলের কিতাবাদি প্রাথমিক শিক্ষাসহ প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন করেন। শৈশব থেকেই তাঁর জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক আচরণ পরিলক্ষিত ছিল। হঠাৎ তাঁর পিতা হযরত সাছি মোহাম্মদ নক্সবন্দি (রহ🙂 ইন্তেকালে মায়ের উপর তার সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পিত হলে তিনি বালক হযরত আলী রজার লেখা পড়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এদিকে হযরত আমানত আল আরবি এর শিষ্য হযরত শাহ ছুফি কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ🙂 কে খেলাফত প্রদানপূর্বক বলেছিলেন যে, তোমার বিহার লক্ষ্‌েণৗতে কাজ নেই। তোমার কাজ আমার মুর্শীদের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করা তাই অতি শীঘ্রই তোমাকে খেলাফতের দায়িত্ব প্রদান করছি। পূর্ব বঙ্গের চাঁনখালী নদীর পশ্চিম পার্শ্বে (গন্তব্য জোয়ার) ওষখাইন গ্রামে হযরত ছিদ্দিকে আকবরের আওলাদ নবীজির চেরাগ হযরত শাহ্‌ আলী রজা কানু শাহ্‌ (রহ🙂 হাতে আমার মুর্শীদের দেওয়া আমানত পৌঁছায়ে দেবে। তিনি মোরশেদের দেওয়া আমানত নিয়ে চাঁনখালীর পশ্চিম পার্শ্বে এসে বেচেইন অবস্থায় পরৈকোড়া বাজারে বালক হযরত আলী রজা (রহ:)’র দেখা হয় ।

আলাপ চারিতায় ওষখাইন গ্রামে এসে মা পরান (রহ🙂 এর সাথে সাক্ষাৎ করে হযরত আলী রজার (রহ🙂 লেখাপড়ার দায়িত্বভার হাতে তুলে নেন। মা পরান (রহ🙂 হযরত আলী রজার দায়িত্বভার শাহ কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ🙂 হাতে তুলে দিতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অবশেষে হযরত শাহ আলী রজা (রহ🙂 কে নিজ সংস্পর্শে রেখে ১৩ বৎসর বয়সে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ছবক দান করেন।

সাহিত্য জীবন : নেপালের রাজ দরবার থেকে সংগৃহীত ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের ধর্মীয় সাধন সঙ্গীত তথা চর্যাপদ থেকে বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত হলেও আমরা মুসলিম সাহিত্যিকের কাব্য পাই ষোড়শ শতাব্দীতে। কবি শাহ্‌ মোহাম্মদ সগীর প্রথম মুসলিম কবি হিসাবে কাব্য রচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আঠারো শতকে তাত্ত্বিক সাধক, পীর, পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ কবি হযরতুল আল্লামা আলী রজা (রহ🙂 এর কাব্য কীর্তির পরিচয় পাই। সাধন মার্গে তিনি বৈষ্ণব, তন্ত্র, যোগ ও সুফি সাধনার আশ্চর্য সমন্বয় করেন।  

পদকার কবি এবং ছুরত নামা ও গ্রোহনাথ প্রণেতা শাহ্‌ শরাফত উল্লাহ্‌ মিয়া (রহ🙂 মধ্য যুগের কবি ও সাধক ছিলেন। আধ্যাত্মিক কবি হযরতুল আল্লামা শাহ্‌ সুফি আলী রজা (রহ🙂 যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেন তা হল : () গোপ্ত তত্ত্বের আগম, () শাস্ত্রীয় আগম, () দেহ বিচার আগম, () জ্ঞান সাগর, () সিরাজ কুলুব, () ধ্যান মালা, () শাহ নামা () সৃষ্টি পত্তন, () যোগ কালন্দর (১০) ষঠচক্র ভেদ, (১১) ইসলাম নামা, (১২) খাবনামা, (১৩) রাগ তাল নামা, (১৪) রফিকুচ্ছালেকীন, (১৫) রাহাতুর রুহ, (১৬) তারিফে রাসূল (দঃ), (১৭) অমর সিং। উপরোক্ত গ্রন্থগুলো বিশ্লেষণ করলে এতে কয়েক শ্রেণির কাব্য পরিচয় পাওয়া যায় । যেমনঃ () প্রণয়োপখ্যান, () মুসলিম ধর্ম সাহিত্য, () মুসলিম বৈষ্ণব পদাবলী, () শাক্ত পদাবলী, () সুফি সাহিত্য, () সাওয়াল সাহিত্য, () রাগতালনামা, () তাল মালা, () রাগ মালা, (১০) কবিরাজী চিকিৎসা শাস্ত্র, (১১) জ্যোতিষ শাস্ত্র, (১২) ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক মসায়েলা এছাড়াও তিনি সাত শতাধিক ভাবমূলক, ভক্তিমূলক, বন্দনামূলক ও তত্ত্বমূলক মারফতী গান রচনা করেন । উপরোক্ত গ্রন্থ ছাড়াও অষ্টাদশ শতকের অন্যতম কবি, আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধক হযরতুল আল্লামা শাহ্‌ ছুফি আলী রজা (প্রকাশ কানু শাহ্‌) (রহ🙂 এর স্বরচিত গ্রন্থ ও কিতাব সমূহ বর্তমানে তাঁহার বংশধরদের মধ্যে পীরজাদা ইলিয়াছ রজার নিকট সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলা একাডেমি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কবির রচিত তিনটি গ্রন্থ ও কয়েকটি মুসলিম বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশ করেন। হযরত শাহ্‌ কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রহ🙂 নিজেই হযরত শাহ আলী রজা (রহ🙂 কে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেলায়তের শক্তি এলমে তাসাউফ এবং তত্ত্বজ্ঞানের গভীরতা দেখে ত্বরিকায়ে চিশতীয়া ও তরিকায়ে মোজাদ্দেদীয়া ছিলছিলার খেলাফত প্রদান করেন। যা তাঁর দাদা পীর হযরত সৈয়দ আমানত আলনয়ামী আল আরবি কর্তৃক গুরু শাহ্‌ কেয়ামুদ্দীন আউলিয়াকে দেওয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, তার গুরু শাহ কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রহ🙂 তাকে কানু নামে ডাকতেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ🙂 এর অধস্তন আউলাদ মজজুবে ছালেকীন শামসুল বেলায়তে মারফতে রহুল আশেকান হযরত পেশ ওয়ায়ে ছারেকান সৈয়দ জিয়াউদ্দিন আহমদ (রহ🙂 এর নিকট হতে কাদেরীয়া নক্‌শবন্দীয়া ছরওয়ারদীয়া ত্বরিকার খেলাফত লাভ করেন। হযরত শাহ আলী রজা (রহ🙂 দীর্ঘকাল আপন মুর্শীদের খেদমতে শরীয়ত ত্বরিকত হাকিকত ও মারেফতের প্রতিস্তর অতিক্রম করে বেলায়তের উচ্চ আসন লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত কঠিন মেহনত ও ৩৬ বছর অরণ্য এবং খানকায় বেয়াজতের পর তার মুর্শিদ আধ্যাত্মিক মসনদের সিংহাসনে আসীন করেন এবং বেলায়তে সম্রাট খ্যাতিতে ভূষিত করে খেলাফতের সম্মানী বেলায়তের তাজ (মুকুট) তাঁর ছের মোবারকে পরিয়ে দেন।

হযরত শাহ্‌ আলী রজা কানু শাহ্‌ (রহ🙂 এর সর্ব শ্রেষ্ঠ অবদান ও কারামত তার নির্দেশিত বিষু মোবারক প্রতি বছর আষাঢ়ের শেষ ও পৌষের শেষ ৩দিন বিষু মোবারক পালিত হয়। ইহা কেবলমাত্র বাবাজান কেবলার ত্বরিকত পন্থীদের জন্য প্রযোজ্য বিধায় সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। তথাপি বিষুর তাৎপর্য সম্পর্কে তার রচিত আধ্যাত্মিক গ্রন্থ জ্ঞান সাগর নামক গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘বিষ্ণু ঋতু ভালমনে যে সকলে জানে জিয়ন মরণ পন্থ শুদ্ধ মতে চিনে’। তার অসংখ্য কারামত জনশ্রুতি আছে। তারই ধারাবাহিকতায় পৌষের শেষ ৩ দিন আনোয়ারা থানাধীন ওষখাইন গ্রামে হযরত শাহ আলী রজা (রহ🙂 দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে মহা সমারোহে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভক্ত অনুরক্ত মুরিদান আশেকানের সমাগমে পবিত্র বিষ্ণু ও ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। বাবাজান কেবলা হযরত শাহ আলী রজা (রহ🙂 ১১৯৯ মঘীর ৫ই মাঘ, ১৯ শাওয়াল মোতাবেক ১৮৩৭ ইংরেজি বুধবার ৭৮ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ