ইক্বামতে দ্বীন–একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বাস্তবায়ন করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন মহান রাব্বুল আ’লামিন। ইকা্বমতে দ্বীন বলতে বোঝায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের ফরজ বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করা এবং তা মেনে চলা। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান– এতে রয়েছে রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, পারিবারিক জীবন–বিধান, কিসাস, হুদুদ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি। জীবনের এমন কোন দিক নেই–যেখানে ইসলামের বিধি–বিধান, অনুশাসন নেই। সবকিছু নিয়েই পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম। ইক্বামতে দ্বীন শুধুমাত্র কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাতকে বোঝায় না। এটির চূড়ান্ত রূপ ও পরিপূর্ণ বিকাশ হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, কোরআনের বিধান প্রবর্তন করা– সর্বোপরি আল্লাহর রাজ কায়েম করা। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামকে অস্বীকারকারীরা শিরক পর্যায়ের অপরাধ করে থাকেন। যেটা তাঁরা উপলদ্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এ কথা সত্য, ইক্বামতে দ্বীন যে শুধুমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থায় কায়েম করা–একথা সঠিক নয়। এটি ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানগুলোসহ সামগ্রিক জীবনধারা মিলেই। তবে ইক্বামতে দ্বীনের সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত অনুষঙ্গ হলো পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে আল্লাহর কোরআন দিয়ে ও রাসূল (সাঃ) এর হাদীস দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করা। যেমন– মহান রাব্বুল আ’লামিন সূরা হাদীদের ২৫ নং আয়াতে বলছেন, ‘আমি অবশ্যই আমার রাসূল (সাঃ) দের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ (মানুষদের কাছে) পাঠিয়েছি এবং আমি তাদের সাথে কিতাব পাঠিয়েছি, আরো পাঠিয়েছি এক ন্যায়দন্ড, যাতে করে মানুষ (এর মাধ্যমে) ইনসাফের ওপর কায়েম থাকতে পারে। তাদের জন্যে আমি লোহা নাযিল করেছি, যার মধ্যে (রয়েছে) বিপুল শক্তি, (আরো রয়েছে) মানুষের বহুবিধ উপকার’। এই আয়াতে ন্যায়দন্ড বা দাঁড়িপাল্লার মাধ্যমে যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে তা কি রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যতীত সম্ভব? এই প্রসঙ্গের সাথে লৌহের কি সম্পর্ক? তাও বুঝতে আমাদের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এখানে লৌহ মানে রাষ্ট্রক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে– যার সাথে ন্যায়বিচারের সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহতায়ালা সূরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নং আয়াতে বলছেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, ফাসেক, জালেম’। একই সূরার ৪৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘তোমার উপর আল্লাহতায়ালা যা কিছু নাযিল করেছেন তুমি তা দিয়ে এদের মাঝে বিচার ফয়সালা করো এবং কখনো তাদের খেয়াল–খুশীর অনুসরণ করো না’। সূরা আন নেসার ১০৫ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি সত্য (দ্বীনের) সাথে তোমার ওপর এ গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে করে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে (ওহী দ্বারা) যা দেখিয়েছেন তার আলোকে তুমি মানুষদের বিচার মীমাংসা করতে পারো; (মীমাংসার সময়) তুমি কখনো বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে তর্ক করো না’। এসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাসনব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা বা ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি ফরজ ইবাদত। দ্বীনের অলঙ্গনীয় শিক্ষা। অতএব তা বাদ দিয়ে ইক্বামতে দ্বীন পরিপূর্ণ হতে পারে না। উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধুমাত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাই যে একমাত্র ইক্বামতে দ্বীন–বিষয়টি এরকম নয় বরং এটি ইক্বামতে দ্বীনের একটি অংশ তথা ইক্বামতে দ্বীনের চূড়ান্ত রূপ ও পরিপূর্ণ বিকাশ। আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা হিসেবে, ‘(হে নবী স্মরণ করো) যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে (আমার) খলীফা বানাতে চাই’। এদিকে সূরা আনয়াম এর ১৬৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি তোমাদের এ যমীনে তাঁর খলিফা বানিয়েছেন’। আর এই খিলাফতের দাবি হল: ধর্মভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এজন্যই আল্লাহতায়ালা হযরত দাউদ (আঃ) কে বলেছিলেন, ‘হে দাউদ, আমি তোমাকে (এই) যমীনে (আমার) খলিফা বানালাম, অতএব তুমি মানুষদের মাঝে ন্যায়বিচার করো এবং কখনো (নিজের) খেয়াল খুশীর অনুসরণ করো না’–সূরা– সোয়াদ– ২৬। নবীগণ (সাঃ) দ্বীনভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইক্বামতে দ্বীন করেছেন। রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলদেরকে নবীরা শাসন করতেন। একজন নবী যখন মারা যেতেন তখন আরেকজন নবী আসতেন তবে আমার পরে আর কোন নবী আসবেন না। (বুখারী মুসলিম)। অনেকেই বলে থাকেন, হযরত মূসা (আঃ) মিশরে যাননি কিংবা মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেননি। একথাটাও সর্বজনস্বীকৃত নয়। বরং পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত থেকে বোঝা যায় হযরত মূসা (আঃ) তাঁর কওম বনী ইসরাঈলদেরকে নিয়ে মিশরে গিয়েছিলেন এবং মিশরের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেছিলেন। সূরা আশ্ শোয়ারাতে ৫৭, ৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতে বলছেন, ‘ আমি তাদের উদ্যানমালা ও ঝর্ণাধারাসমূহ থেকে বের করে আনলাম, তাদের ধনভান্ডারসমূহ ও সুরম্য প্রাসাদ থেকে, এভাবেই আমি বনী ইসরাঈলদের (ফেরাউন ও তাদের) লোকজনদের সব কিছুর মালিক বানিয়ে দিলাম’। অন্যদিকে সূরা আদ দোখানের ২৫ ও ২৭ নং আয়াতে বলছেন, ‘ওরা নিজেদের পেছনে কতো উদ্যান, কতো ঝর্ণা ফেলে গেছে, কতো ক্ষেতের ফসল, কতো সুরম্য প্রাসাদ, কতো (বিলাস) সামগ্রী যাতে ওরা (সব সময়) নিমগ্ন থাকতো, এভাবেই আমি আরেক জাতিকে এসব কিছুর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিলাম’। যেহেতু কোরআন কোরআনের ব্যাখ্যা, তাই এখানে অন্য একটি জাতি বলতে বনী ইসরাঈলকে যে বোঝানো হয়েছে তা সূরা আশ শোয়ারা থেকেই প্রমাণিত হয়। এদ্বারা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বনী ইসরাঈল মূসা (আঃ) এর নেতৃত্বে আবার মিশরে গিয়েছিলো। এটি প্রখ্যাত মোফাচ্ছির হাসানের অভিমত। তবে হযরত কাতাদাহ (রাঃ) এর মত হচ্ছে বনী ইসরাঈল নয়–এটি অন্য একটি জাতি। তবে প্রথম মতটি যে আয়াতগুলোর কাছাকাছি তা সহজেই বোঝা যায়। (পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল