চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আরো একটি ২০ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনা ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এক হাজার শয্যার নতুন এ ভবন চট্টেশ্বরী সড়কের গোঁয়াছি বাগান এলাকায় হাসপাতালের নিজস্ব জায়গায় স্থাপনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের স্বাক্ষরে এ প্রস্তাবনা সম্বলিত একটি চিঠি গত ১৬ মে স্বাস্থ্য অদিধপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) বরাবর পাঠানো হয়েছে। ২০ তলা ভবনের ফ্লোর বিন্যাসসহ (কোন ফ্লোরে কোন ওয়ার্ড) অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবনায়। প্রস্তাবনা সম্বলিত চিঠি পাঠানোর তথ্য আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।
প্রসঙ্গত, চমেক হাসপাতাল এলাকায় সিএমসিএইচ ‘টু’ নামে ২০ তলা একটি ভবন নির্মাণের প্রকল্প এরই মধ্যে অনেকদূর এগিয়েছে। হাসপাতালের সামনে থাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) পুরনো একাডেমিক ভবনটির স্থলে নতুন এই অবকাঠামো (২০ তলা ভবন) নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। যদিও প্রথম দিকে এটি ৫০০ শয্যার অবকাঠামো হিসেবে দশ তলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ৫০০ শয্যার পরিবর্তে ১ হাজার শয্যার অবকাঠামো হিসেবে এখানে ২০ তলা ভবন করার পরিকল্পনার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০ তলা ভবনের ফ্লোর বিন্যাসসহ (কোন ফ্লোরে কোন ওয়ার্ড) বিস্তারিত প্রস্তাবনা চেয়ে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশনা পেয়ে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে গত ৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে পাঠায় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চমেক হাসপাতালের বিদ্যমান অবকাঠামোতে ১৩১৩ শয্যার প্রশাসনিক অনুমোদন রয়েছে। নতুন ২০তলা ভবনে প্রায় ১ হাজার শয্যার সংস্থান ধরে সবমিলিয়ে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ২২শতে উন্নীতকরণের কথা বলা হয় আগের (৯ মার্চ পাঠানো) প্রস্তাবনায়। আর ২০ তলা ভবনের দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় (১৬ মে পাঠানো) আরো ১ হাজার শয্যার সংস্থান ধরে হাসপাতালের মোট শয্যা ৩ হাজারে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ২০ তলা বিশিষ্ট দ্বিতীয় ভবন নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়ন হলে চমেক হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩ হাজারে দাঁড়াবে।
চমেক হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) এর দপ্তরে হাসপাতালসমূহের অবকাঠামো সংক্রান্ত এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চমেক হাসপাতাল কর্তৃক ৯ মার্চ পাঠানো প্রস্তাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। নতুন অবকাঠামো ও শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে বৈঠকে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তথ্য-উপাত্তের সহায়তায় চমেক হাসপাতালে গড়ে ৩ হাজারের বেশি (৩১৭৭টি) শয্যা প্রয়োজন বলে বুঝাতে সক্ষম হন হাসপাতাল পরিচালক। এর প্রেক্ষিতে চমেক হাসপাতালে নতুন ১ হাজার শয্যার স্থাপনা যথেষ্ট নয় বলে মতামত উঠে আসে বৈঠকে। ফলস্বরুপ অতিরিক্ত আরো একটি ১ হাজার শয্যার অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে চমেক হাসপাতাল প্রশাসনকে প্রস্তাবনা পাঠাতে বলা হয়। মূলত এর ভিত্তিতেই ১ হাজার শয্যার আরো একটি ২০ তলা নতুন ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। ২০ তলা একটি ভবন যেহেতু হাসপাতালের সামনে (চমেক এর পুরনো একাডেমিক ভবনের জায়গায়) নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেহেতু দ্বিতীয় ২০ তলা ভবনটি চট্টেশ্বরী সড়কের গোয়াঁছি বাগান এলাকায় স্থাপনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক।
হাসপাতাল পরিচালকের স্বাক্ষরে গত ১৬ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) বরাবর পাঠানো (দ্বিতীয়) প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠালগ্নে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করে অবকাঠামো ও জনবল পুনবিন্যাস করা হয়। পরবর্তীতে বিদ্যমান জনবল ও অবকাঠামোতেই ১৩১৩ শয্যায় উন্নীত করা হয়। অর্থাৎ বর্তমানে ৫০০ শয্যার অবকাঠামোতে ১৩১৩ শয্যার প্রশাসনিক অনুমোদনক্রমে হাসপাতালের কার্যক্রম চালু আছে।
কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদন ১৩১৩ শয্যার হলেও হাসপাতালে দৈনিক প্রায় তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকে এবং প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪ হাজার রোগী আউটডোরে সেবা গ্রহণ করে। এছাড়াও প্রায় ২০-২২টি নতুন বিভাগ সংযোজনের কারণে বর্তমানে স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৫০০ শয্যার বিদ্যমান অবকাঠামোতে বর্তমানে বেড অকুপেন্সি হার ৫৪৩ শতাংশের বেশি। বিভাগ অনুযায়ী বর্তমানে হাসপাতালে শয্যার গড় চাহিদা ৩১৭৭টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে হাসপাতাল সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিকভাবে ১ হাজার শয্যা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিগত ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) এর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায় হাসপাতালে ১ হাজার শয্যার নতুন স্থাপনা যথেষ্ট নয় বলে প্রতীয়মান হয়। এর প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত আরও ১ হাজার শয্যার নতুন একটি ভবন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রস্তাবনা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে আরো ১ হাজার শয্যার নতুন অবকাঠামো নির্মাণের এই প্রস্তাবনা প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রেরণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
উল্লেখ্য, মাত্র ৫০০ শয্যার অবকাঠামোতে নির্মিত চমেক হাসপাতালের বর্তমান শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩। প্রশাসনিক আদেশে ধাপে ধাপে এই শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও বাড়েনি জনবল। অধিকন্তু ১ হাজার ৩১৩ শয্যার বিপরীতে প্রতিনিয়ত প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকছে গরিবের হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত এই হাসপাতালে। তবে এই তিন হাজার রোগীর সেবা চলছে সে-ই ৫০০ শয্যার জনবলেই। তাছাড়া ৪২টি ওয়ার্ড বিশিষ্ট এই হাসপাতালে স্থান সংকটও চরম পর্যায়ে। শয্যা ছাড়িয়ে মেঝে, বারান্দা, করিডোর এমনকি সিঁড়িতেও রাখতে হচ্ছে রোগীকে। জনবল ও স্থানের এমন চরম সংকট নিয়ে এতদঞ্চলের বিশাল সংখ্যক রোগীর চাপ যেন আর নিতে পারছে না হাসপাতালটি। সবমিলিয়ে গরিবের এ হাসপাতালটি বর্তমানে রোগীর ভারে বিপর্যস্ত। এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বিদ্যমান হাসপাতালের জন্য ১ হাজার শয্যা ধারণ ক্ষমতার নতুন একটি ভবন নির্মাণের পাশাপাশি নগরে বিশেষায়িত আরো তিনটি হাসপাতালের প্রস্তাব করে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিনের স্বাক্ষরে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত হিসেবে একটি শিশু হাসপাতাল, একটি হৃদ রোগ হাসপাতাল এবং অপর একটি ট্রমা (অর্থোঃ সার্জারি) হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয় চিঠিতে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, শুধু চট্টগ্রাম মহানগরেই অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। এর বাইরে চট্টগ্রামসহ এতদঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবায় চমেক হাসপাতাল একমাত্র ভরসাস্থল। শিল্পায়ন, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন কারণে হাসপাতালে দিন দিন রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে নির্দিষ্ট কিছু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ সহনীয় মাত্রার বাইরে। এরমধ্যে শিশু স্বাস্থ্য ওয়ার্ডে প্রতিনিয়ত প্রায় ৬ শতাধিক, হৃদরোগ ওয়ার্ডে ৩৫০, অর্থোপেডিক (ট্রমা) ওয়ার্ডে ৩ শতাধিক এবং নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে প্রতিনিয়ত ২ শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে। এসব ওয়ার্ডের প্রতিটির রোগীর সংখ্যা একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের রোগীর সংখ্যারও বেশি। এর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিশেষায়িত একটি শিশু হাসপাতাল, একটি হৃদরোগ হাসপাতাল এবং অপর একটি ট্রমা (অর্থোঃসার্জারি) হাসপাতাল গড়ে তোলার অপরিহার্যতার বিষয় তুলে ধরা হয় চিঠিতে।
অবশ্য, চমেক হাসপাতালে ২০ তলা বিশিষ্ট দুটি ভবন নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অর্থোপেডিক, হৃদরোগ, নিউরোসার্জারিসহ অধিকাংশ বিভাগের চিকিৎসা সেবা অনেকটা বিশেষায়িত হাসপাতালের আদলেই দেয়া যাবে বলে মনে করেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই ২০ তলা ভবনে ফ্লোর বিন্যাস সাজানো হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।