‘একজন প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, যিনি আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, সংবিধান প্রণেতা ছিলেন এবং সর্বোপরি তিনি সার্বজনীনভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যিনি শ্রেষ্ঠ বেসামরিক পুরস্কারটি পেয়েছেন। বলা যায়, মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও সামপ্রদায়িকতা বিরোধেী আন্দোলনে তিনি পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তাঁকে বলা হয় বিবেকের কণ্ঠস্বর। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার অঙ্গনে শুধু নয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, নাগরিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন বড় মাপের মানুষ। বাঙালির জাতীয় মানস গঠনে, সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্বোধনে ও সম্প্রীতিবদ্ধনে তরুণ ও নারী সমাজসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করেছেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মতৎপরতা, আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা, মুক্তিযোদ্ধোদের প্রশিক্ষণে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। একবিংশ শতাব্দীতে যদি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মতো নতুন প্রজন্মের কিছু মানুষ গড়ে ওঠে, তাহলে দেশ জাতি ও কৃষ্টি প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে শিক্ষা আমরা নিয়েছিলাম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বা আগামীর নেতৃত্ব যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ এবং তাঁর সৈনিক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশের বোধগুলোকে ধারণ করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ একদিন সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবে।’ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার এসব কথা বলেন। গতকাল সোমবার বিকেলে ‘সমাজের শুদ্ধ বিবেক মোহাম্মদ খালেদ’- শীর্ষক এ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব। স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তা ছিলেন ড. শিরীণ আখতার। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রেসক্লাব সভাপতি আলহাজ্ব আলী আব্বাস। স্বাগত বক্তব্য দেন, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী।
স্মারক বক্তা ড. শিরীণ আখতারের পরিচিতি ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন-কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ। ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সন্তান স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির।
ড. শিরীণ আখতার বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি পর্যায়ে ছিল যখন আমরা দীর্ঘ একটি স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে চলেছি। যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বৃহত্তর চট্টগ্রামে তখন আমাদের বাতিঘর আমাদের বিবেকের কণ্ঠস্বর খুব ক্ষুদ্র থেকে বড় কোনো সমাবেশে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছিলেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় অনেকে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের উপর গবেষণা করেছেন, কাজ করেছেন, দুটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি এখনও সঠিকভাবে তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। আমি আজকে এখান থেকে বলতে চাই, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে মানব চরিত্রের কথা, আমাদের বাঙালি চরিত্রের কথা- ‘আমরা ফেরেশতার মতো কথা বলি, শয়তানের মতো আচরণ করি’। এ ধরনের মহাবাণী সমৃদ্ধ ভাষণ, অভিভাষণ, বক্তব্য, সভাপতির কথন অথবা বিভিন্ন জায়গায় বলা তাঁর কথাগুলো গ্রন্থিত হয়নি, সম্পাদিত হয়নি। প্রবাদ আছে- To be good teacher one should be a good student first। চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের ছোটবড় যেকোনো অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দিলেই তিনি যেতেন। মধুর ভাষা ও অকাট্য যুক্তিসহকারে জনগণ ও সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কথা আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বলে যেতেন।
ড. শিরীণ আখতার বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন আদর্শবান সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ইতিহাসবিদ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন মন্তব্য করেন, ‘তিনি প্রকৃতই সৎ মানুষ। একদিকে একটি প্রসিদ্ধ পত্রিকার সম্পাদক, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ। এত সুযোগ তারপরও তিনি শুদ্ধ থেকেছেন এটাই তাঁকে মহৎ মানুষের কাতারে এনেছে।’ বলতে পারি, সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ছিলেন সফল সৈনিক। নীতির ব্যাপারে ও সত্যানুসন্ধানে তিনি ছিলেন আপসহীন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কোনো নীতি বিবর্জিত কর্মে তিনি লিপ্ত হননি। সত্য ও ন্যায়ের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে কাজ করেছেন। আদর্শ ও পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘একটা পত্রিকার সম্পাদক হওয়া মানে জাতির পুনর্গঠনে সহযোগিতা দেয়া। অধ্যাপক খালেদ শুধু সম্পাদক হিসেবে নন, শুধু সাংবাদিক হিসেবেও নন, সামাজিক ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অনেক অবদান রেখেছেন।’
প্রফেসর খালেদ সাহেব একটা কথা বলতেন, মোনায়েম খান তাকে ডেকেছিলেন গোর্কির সময়। বাসায় ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘এটা কি ছাপছেন? খালেদ সাহেব বললেন, এটা তো আমি ছাপিনি, এটা তো এএফপি ছেপেছে। ওখান থেকে নিয়ে আমি রিপ্রিন্ট করেছি। তিনি তাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে উত্তর দিয়েছিলেন। গোর্কির সময় আজাদী একমাত্র নিউজ করেছিল, অন্যকোনো পত্রিকা নিউজ করতে পারেনি। আর ৬৯-৭০ এর সময় দৈনিক টেলিগ্রাম হিসেবে আমরা দেখেছি সন্ধ্যায় একপাতার টেলিগ্রাম বের করতেন। এখানে আজাদীর এম এ মালেক সাহেবকে শ্রদ্ধা জানাতে হয় এ কারণে, তিনি সেসময় আরেকটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। অধ্যাপক খালেদ সাহেব তখনও ভারত থেকে ফেরত আসেননি। কিন্তু সবাই মিলে স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ শিরোনামে লাল কালি দিয়ে ছাপাতে পেরেছিলেন।
আমরা লক্ষ্য করেছি, এখানে খালেদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের যে নেতৃত্ব, সেখানে সাংবাদিক হিসেবেও একটা বড় নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যকোনো সাংসদ নিতে পারেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আজাদী একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় আজাদী পত্রিকা পুড়ে ফেলা হয়। গভর্নর মোনায়েম খানের ব্যবস্থাপনায় এটা করেছিলেন। তার কারসাজিতে কুমিল্লায় ঘটনাটি ঘটেছিল। কেননা তারা বিশ্ববিদ্যালয়টি কুমিল্লায় করতে চেয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। প্রয়াত সাংবাদিক নজির আহমদ তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেন, ‘১৯৬১-১৯৬২ সালেই দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জে. আজম খান জামালখান এলাকায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অধ্যাপক খালেদসহ অন্যান্যের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।’ চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও অধ্যাপক খালেদ সক্রিয় ছিলেন।
অধ্যাপক খালেদ সম্পর্কে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর উদ্বৃতি তুলে ধরে স্মারক বক্তৃতায় বলা হয়, ‘তিনি মানুষের অন্তর আকর্ষণ করেছেন। মানুষ তাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে কাছে টানে। তার মধ্যে গুণাবলির সমাবেশ না ঘটলে তাকে ঋদ্ধ সমাজ শ্রদ্ধা করবেন কেন? আমিও তার সাথে অনেক সভা-সমিতিতে যোগ দিয়েছি। বিনয়ী, নিরহঙ্কার, স্বল্পভাষী অধ্যাপক সাহেবের কথা মানুষ মন দিয়ে শোনে আমি দেখেছি। আমিও দূর হতে শ্রদ্ধা করি আজাদী পত্রিকা সম্পাদক সাহেবকে।’
বস্তুত মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে জাতীয় ও সামাজিক সমস্যার দিকনির্দেশনামূলক কথাগুলো বলার জন্য তিনি নিজের ভেতর তাগাদা অনুভব করতেন। তাঁর মতো লোককে বলা হয় শুদ্ধতম মানুষ। এসব মানুষ গাড়ি বাড়ির মালিক হতে পারেন না, তিনিও হননি। কিন্তু তিনি যা হয়েছেন তাঁর মতো লোক সমাজে খুব বেশি সৃষ্টি হয় না। অধ্যাপক খালেদের উল্লেখযোগ্য অভিভাষণগুলো ধারণ করার জন্য, একটা প্রকাশনা করবার জন্য চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবকে অনুরোধ জানিয়ে ড. শিরীণ আখতার বলেন, এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব শুধু নয়, আমাদের সমগ্র শুদ্ধাচার সাংবাদিক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন কিংবা দৈনিক আজাদীও এর সাথে যুক্ত হতে পারে। আমরা চাই, তার ভাষণ-অভিভাষণ নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করা হোক।
স্মারক বক্তার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ বলেন, আমার সৌভাগ্য, অধ্যাপক খালেদের সান্নিধ্যে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি নির্লোভ-সাহসী একজন সাংবাদিক ছিলেন। আরো একটি আনন্দের বিষয় যে, আমি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর নামে (অধ্যাপক খালেদ) এই স্মারক বক্তৃতাটি আমরা প্রবর্তন করতে পেরেছিলাম। এবারও এই স্মারক বক্তৃতা আয়োজনে প্রেসক্লাবের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। স্মারক বক্তা প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য উল্লেখ করে রাশেদ রউফ বলেন, তিনি একাধারে গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক। সমপ্রতি তিনি মর্যাদাবান বেগম রোকেয়া পদক লাভ করেছেন।
বাবার নামে প্রতিবারের ন্যায় এবারও স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করায় পরিবারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান অধ্যাপক খালেদের সন্তান মোহাম্মদ জহির।
সভাপতির বক্তব্যে প্রেসক্লাব সভাপতি বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মতো গুণী ব্যক্তিত্ব সাংবাদিকতা পেশায় এসে সাংবাদিক সমাজকে আলোকিত করেছেন। আজ আমরা যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি; তা অধ্যাপক খালেদের কল্যাণে/ বদান্যতায়। এমন মানুষের নামে স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করতে পেরে আমরা নিজেরা গৌরববোধ করছি। পরবর্তীতে সুযোগ পেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের উদ্যোগে অধ্যাপক খালেদকে নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করার ঘোষণা দেন প্রেসক্লাব সভাপতি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মাঝে প্রেসক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটির অর্থ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রূপম চক্রবর্তী, গ্রন্থাগার সম্পাদক রাশেদ মাহমুদ, সমাজসেবা ও আপ্যায়ন সম্পাদক মো. আইয়ুব আলী, কার্যকরী সদস্য স ম ইব্রাহীম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।