লাইলাতুল কদর হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ | রবিবার , ৯ মে, ২০২১ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

আজ মাহে রমজানের ২৬ তারিখ। আজ রবিবার দিবাগত রাতই পবিত্র লাইলাতুল কদর। এ লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্যে একটি পুণ্যময় রজনী । আমাদের মাঝে এসেছে আল্লাহপাক যে একটি রাত ইবাদত বন্দেগিতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক সাওয়াব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে গৌরবময় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী । কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী। মহান আল্লাহ এ রজনীর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- ‘নিশ্চয় আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর আপনি কী জানেন কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (হজরত জিবরাইল) অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।’ -(সুরা আল-কদর, আয়াত: ১-৫) একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) বনী ইসরাইলের শামউন নামক একজন আবিদ ও জাহিদের দীর্ঘকালের কঠোর সাধনা সম্পর্কে বলছিলেন। সে মহৎ ব্যক্তি এক হাজার মাস লাগাতার সিয়াম ও জিহাদে রত থাকতেন এবং সারারাত জেগে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও জিক্‌র -আজকারে কাটিয়ে দিতেন। সাহাবায়ে কিরাম আবিদ ও জাহিদের কথা শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ুর কথা ভেবে আফসোস করে বললেন- হায়! আমরাও যদি ঐ লোকটির মতো দীর্ঘ হায়াত পেতাম তাহলে আমরা ওই রকম ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতাম। এ সময় মহান আল্লাহ এ সম্মানিত সুরা আল-কদর অবতীর্ণ করেন।
‘লাইল’ এবং ‘কদর’ দু’টিই আরবি শব্দ। ‘লাইল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্মান। পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো সম্মানিত রাত। তবে কদর শব্দের অর্থ আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে- মাহাত্ম্য, তাকদির, আদেশ ইত্যাদিও হতে পারে। লাইলাতুল কদরকে শবে কদরও বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থও রাত। ইমাম জুহরী (রহ.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী এ জন্য বলা হয় যে, মানব জীবনের জন্যে এ রাত অত্যন্ত মূল্যবান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) বলেছেন- এ মহান রাতে ইবাদতের কারণে এমন লোকেরও মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়, ইতোপূর্বে যাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান ছিলো না। তাই এ রাতকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়। ‘কদর’ শব্দের অন্য অর্থ হচ্ছে আদেশ ও তাকদির। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লিখা থাকে তা এক রমজান থেকে অপর রমজান পর্যন্ত সরবরাহের হুকুম ও দায়-দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হজরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা.)-এর এক বর্ণনা মতে, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তায়ালা এক বছরের জন্যে বান্দার রুজি, রিজিক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তাকদিরি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ এবং রুজি-রিজিক প্রভৃতি সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে থাকেন। -(তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড- ২০, পৃ.- ১১৫)
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার মাস ইবাদত করে যে সাওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদতে তার চেয়ে বেশি সাওয়াব হয়। লাইলাতুল কদরের এ ফজিলতপূর্ণ রাতে মুমিনদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও নাজাতের পরম সুযোগ লাভ করা যায়। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিসে এসেছে- হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদা রমজান আগমন করলে রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন- ‘তোমাদের সামনে এমন একটি মাস এসেছে। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদত থেকে বঞ্চিত হলো; সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। একমাত্র হতভাগ্য ব্যক্তিই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’-(সুনানে ইব্‌ন মাজাহ, হাদিস নং- ১৬৪৪)
লাইলাতুল কদর কোন্‌ রাত তার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাফসিরে মাজহারি গ্রন্থকার আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) বলেছেন- লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ দিনে হয়ে থাকে। কিন্তু এরও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই; বরং যে কোনো রাতে হতে পারে। বুখারি শরিফের হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘তাহাররু লাইলাতাল কদরি ফি আশারিল আওয়াখিরি মিন রমজান’ অর্থাৎ রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর। -(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস নং- ৭৯২) হাদিসে এসেছে, হজরত উবাদা ইব্‌ন সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবী (সা.) আমাদেরকে লাইলাতুল কদর সমপর্কে সংবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। তখন দু’জন মুসলিম ঝগড়া করছিলো। অতঃপর (বিবাদ নিরসনের পর) রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দেওয়ার জন্যে বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুকের ঝগড়া-বিবাদের কারণে নির্দিষ্ট তারিখের জ্ঞান আমার অন্তর থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। সুতরাং তোমরা উক্ত রাতকে ঊনত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ তারিখের রজনীতে অনুসন্ধান করো। -(সহিহ আল-বুখারি, হাদিস নং- ২০২৩) হজরত আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে রমজানের মধ্যম দশকে ইতিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিলো পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান করো।’ -(সহিহ আল-বুখারি, হাদিস নং- ২০১৬) অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘রমজানের শেষ দশ দিনে বেজোড় রাত্রে তোমরা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’ -(সহিহ আল-বুখারি, হাদিস নং- ২০১৭)
লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট রাখার মধ্যেও অসংখ্য তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। যদি নির্দিষ্ট তারিখ থাকতো তাহলে সবাই একটি মাত্র রাতে ইবাদত করে নিশ্চিত মনে স্বীয় আমলের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতো। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষ যাতে লাইলাতুল কদর খুঁজতে গিয়ে বেশি বেশি ইবাদত করে তাই আল্লাহ তায়ালা এই তারিখটি অনির্দিষ্ট রেখেছেন। তবে বুজুর্গানে দ্বীন গবেষণার মাধ্যমে বেজোড় রাতের মধ্যে ২৭ তারিখের রাতকে নির্ধারণ করেছেন। মোট কথা, লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহে ইবাদতে মশগুল থাকা বাঞ্চনীয়। তবে সাতাশতম রাতের ব্যাপারে বেশি বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এ মোতাবেক উম্মতের মধ্যে আমল জারি রয়েছে। তবে হাদিসে এ রাতের কিছু বৈশিষ্ট্য এসেছে। হাদিসে এসেছে- হযরত উবাদা ইব্‌ন সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- সেই রজনীটি চন্দ্রালোকিত রজনীর মতো উজ্জ্বল, পরিষ্কার, নীরব ও নাতিশীতোষ্ণ হবে। সকাল পর্যন্ত কোনো তারকা খসে পড়বে না। পরবর্তী সকালের সূর্যকিরণ পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উষ্ণতাহীন হবে। -( মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং- ২২৭৬৫)
আজকের রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ রাতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করুন। কুরআন শরিফ তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে ব্যক্তি এর বদলে একটি নেকী লাভ করবে। আর একটি নেকী হলো দশটি নেকীর সমান।’ -(সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং- ২৯১০) হাদিসের মধ্যে আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা কুরআন পড়। কেননা, এ কুরআন কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্যে সুপারিশ করবে।-(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৮০৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য হাদিসের মধ্যে ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি কুরআনুল কারিম অধ্যয়ন করবে এবং তদানুযায়ী আমল করবে কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো দুনিয়ার সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হবে।’ -(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং- ২১৩৯)
লাইলাতুল কদর মানব জাতির জন্যে অত্যন্ত পুণ্যময় রাত। কদরের রাতে আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্যে অশেষ রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভের বিশেষ সুযোগ এনে দেন। আসুন, অফুরন্ত নিয়ামত লাইলাতুল কদর তালাশ করতে আমরা সচেষ্ট হই।
লেখক: গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসিজোফ্রেনিয়া রোগীর চরিত্রে মৌ