মৃত্যুবার্ষিকীতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম

মহিমা তব

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ


অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ কিসে বড়? নানাদিকে তাঁর প্রতিভা আকৃষ্ট হয়েছে; যখন যেদিকে বিচরণ করেছেন, সেখানেই শ্রেষ্ঠত্বের আসন কত সহজেই না তাঁর অধিকৃত হয়েছে। জীবনের সর্বত্র শ্রেষ্ঠত্বের আসনখানি যেন তাঁর জন্যই সৃষ্টি হয়েছিলো এবং তাঁকে সেই আসনোপরি বসিয়ে সকলে ধন্য হয়েছেন। এমন মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় না।
সাংবাদিকতার কথাই ধরি। দৈনিক আজাদী দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের আরম্ভ এবং আজাদী দিয়েই শেষ। এও এক কীর্তি। গোটা জীবন একই পেশায় এবং একই কর্মস্থলে অবিচ্ছিন্ন কাল কাটিয়ে দেবার নজিরও বোধ করি একমাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদেই পাওয়া যাবে। আজাদী পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক এমএ মালেকের জন্মদিন উপলক্ষে সে পত্রিকার জন্য লেখা কিন্তু প্রকাশিত না হওয়া ক্ষীণতনু এক নিবন্ধে আমি মালেক সাহেবকে দেশের ‘সর্বজ্যেষ্ঠ সম্পাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম; এখন খালেদ সাহেবকে ‘দীর্ঘকালীন সম্পাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করছি।
আমার যদি স্মৃতি বিম্ভ্রম না ঘটে থাকে, তাহলে যতদূর স্মরণ করতে পারছি ‘দৈনিক আজাদী’র জন্ম হয়েছিলো ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম বা প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মহাত্মা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক। তিনি সেকালেই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর সময়ে চট্টগ্রামে আর ক’জন শিবপুর পাস করা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আমার জানা নেই। বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যকলার জনক স্থপতি মযহারুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর পরেই শিবপুরে পড়তে গিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত নই, আমার ভুলও হতে পারে। চট্টগ্রাম পৌরসভার বহুকালের প্রধান প্রকৌশলী এম আই খান সম্ভবত এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন। তবে বয়সে তিনি ইঞ্জিনিয়ার খালেদের চেয়ে ছোট এটা আমি জানি।
সবাই মনে করে ‘আজাদী’ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র কীর্তি। কিন্তু আরো দুটি কীর্তি তিনি স্থাপন করে গেছেন, যে কারণে চট্টগ্রামের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন। সে দুটি কীর্তি হলো কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও ‘কোহিনূর’ পত্রিকা। কোহিনূর লাইব্রেরির কথা বললাম না, যদিও চট্টগ্রামে মননশীলতার বিকাশে অধুনালুপ্ত এই প্রতিষ্ঠানটির অবদানও অকিঞ্চিৎকর নয়। কোহিনূর পত্রিকা পঞ্চাশের দশকে বেশ মান সম্পন্ন একটি সাহিত্য পত্রিকা ছিলো। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস তো চট্টগ্রামের মুদ্রণশিল্পে একটি বিপ্লবই ছিলো বলা যায়। প্রথম অফসেট প্রেস কি শফি সাহেবের আর্ট প্রেস ? সেটি সম্ভবত ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের জন্ম ১৯৩০ বা ৩১ সালের ঘটনা। আরেকটা কারণে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কথা মনে রাখতে হবে। সেটি হলো-১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রহত্যার সংবাদ শুনে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে মামা আহমদ ছগীর চৌধুরীর বাসায় রোগশয্যায় শুয়ে ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক একুশের প্রথম কবিতা লেখার পর সেটি চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের সংগঠন করা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে ছাপতে দেন। সম্ভবত চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং এড. কামাল উদ্দিন আহমদ খান কবিতাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তারিখ পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি হওয়ারই কথা। সেদিনই পুলিশই কথাটা জেনে যায় এবং রাতে প্রেসে হানা দেয়। তখন বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিলো। পুলিশের আগমন টের পেয়ে প্রেস কর্মীরা ছাপার সরঞ্জাম লুকিয়ে ফেলে। পুলিশ কিছু কবিতা পেয়ে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে ম্যানেজার দবিরউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ করে প্রকাশক পাথরঘাটা নিবাসী এড. কামালউদ্দিন আহমদ খানের নামে হুলিয়া জারি করে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে জনসভায় চৌধুরী হারুনুর রশিদ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
আশ্চর্য রাউজানের একটি পরিবার চট্টগ্রামে শিল্প ও মননশীলতায় কী বিপুল অবদান রেখে গেছে তা’ আমাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি পত্রিকা, সাময়িকী, লাইব্রেরি ও মুদ্রণ যন্ত্রে আধুনিকতার অভিযাত্রী হন, তাহলে তাঁর চাচাতো ভাই প্যারামাউন্ট ব্লকের স্বত্বাধিকারী আবু মিয়া (আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম) ছিলেন অন্যদিক থেকে মুদ্রণ জগতে শিল্প রুচির প্রবর্তক। তাঁর প্যারামাউন্ট ব্লকই চট্টগ্রামের মুদ্রণ শিল্পে আভিজাত্য ও সুরুচির আমদানি করেছিলো।
যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেক সাহেব যখন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করেন, সেটা সত্যি চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্পে যুগান্তর ঘটিয়েছিলো। তিনি একজন যোগ্যতর সাংবাদিক, আমার নানা হাবিবুর রহমান খানকে বার্তা সম্পাদক পদে নিয়োগ দান করে তাঁর নতুন পত্রিকাটি গড়ে তোলার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। প্রায় সম সময়ে, (হয়তো সময়ের একটু হেরফের হতে পারে) অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদেরও পদার্পণ চট্টগ্রামের সাংবাদিকতায়। তিনি নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যেদিন তাঁর কন্যার সঙ্গে সদ্য পরিণীত জামাতাটিকেও তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় এনে বসিয়ে দিলেন, সেদিনই সবার অলক্ষে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে গেল। জামাতাকে অধ্যাপনা ছাড়িয়ে এনে পত্রিকার হাল ধরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে একটি ইতিহাসের গোড়াপত্তন হলো। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আর বেশিদিন বাঁচেন নি। পত্রিকা প্রকাশের দু’বছরের মধ্যে তাঁর প্রভুর কাছে প্রস্থান করলেন এই স্বর্গীয় পুরুষটি।
অতঃপর আজাদীতে অধ্যাপক খালেদ যুগের শুভারম্ভ। অধ্যাপক খালেদের জীবন এবং আজাদী দুই ভাইয়ের মত হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে। এক সময় অধ্যাপক খালেদ ও আজাদী প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিলো। আজাদী বলতে অধ্যাপক খালেদ এবং অধ্যাপক খালেদ বলতে আজাদীকে বুঝানো হতো।
তখন আজাদীর শৈশব দশা ঘোচেনি, হামাগুড়ি দিচ্ছে; সেই পত্রিকাকে তিনি পিতৃ ও মাতৃস্নেহে পরিচর্যা করে চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রচারিত ও মর্যাদাবান দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। কিঞ্চিদধিক চার দশক কাল তিনি আজাদী সম্পাদনা করেছেন, এই সময়ের মধ্যে আজাদীর বার্তা ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অবশ্য তাঁর পরপরই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের শিবরাত্রির সলতে এমএ মালেকও পরিচালনা সম্পাদক হিসেবে আজাদীর কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং খালেদ-মালেক উভয়ের যৌথ চেষ্টায় বিজ্ঞাপন, প্রশাসন, হিসাব, প্রচার সবদিক দিয়ে একটি পরিপূর্ণ সংবাদপত্র হাউস হিসেবে আজাদী গড়ে উঠেছিলো। একই সঙ্গে অধ্যাপক খালেদ চট্টগ্রাম শহরের বিশেষ মান্য ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অর্জন করেন। ষাটের দশকে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয়, যখন আধুনিক চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠছিলো, গণপরিবহন বাসের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে, পুরোনো গ্যাস বাতির স্থলে বিজলিবাতির লাইন বসেছে রাস্তায়, জীবন যাত্রায় আধুনিকতা তথা বহুমাত্রিকতার ছোঁয়া এনেছিলো অ্যাডভেঞ্চার ও রোমান্টিকতা, পুরোনো দুটি কলেজ চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও বাণিজ্য কলেজের স্থলে সিটি কলেজ, এমইএস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমনকি চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যার ফলে চট্টগ্রাম শহরে চোখে পড়ার মতো একটি ছাত্র সমাজ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিলো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ছিলো পত্রিকার পাঠক।
এসময় ইস্পাহানি ও একে খানের পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা শিল্পপতি ও ধনীর কাতারে উন্নীত হওয়া ছাড়াও আইয়ুব খানের ওজিএল-এর বদৌলতে অনেক নতুন নতুন ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির বিকাশের ফলে অর্থনীতির আকারে বেড়ে গিয়েছিলো। এই সমস্তটা নিয়ে খবরের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছিলো। পত্রিকার পাঠকও বাড়ছিলো। সংবাদপত্রের সামনে যে নতুন চ্যালেঞ্জ এসে উপস্থিত হয়েছে, খালেদ সাহেব সেটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাঁর নিউজ টিম নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোবাবেলায় প্রস্তুত হয়েছিলেন বলেই তিনি যেমন সফল সম্পাদক হিসেবে গণ্য হলেন, তেমনি তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা আজাদীকেও মার্কেট লিডার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ষাটের দশকের আর একটা তাৎপর্য ছিলো। সেটি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। বায়ান্ন যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভেরিবাদন হয়, ষাটের দশকে দুন্দুভি বাজিয়ে সগর্জনে প্রকাশিত হয়েছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা কর্মসূচি দিয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের খোলামুখ থেকে আসা দুরন্ত বাতাস যেন সূর্য সেনের বিপ্লবী চট্টলার কানে কানে নতুন বিদ্রোহ-বিপ্লবের মন্ত্রগুপ্তি দিয়ে যাচ্ছিলো। ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতিসত্তা জেগে উঠলো, স্বাধীনতা ছাড়া কম কিছুতে তার তৃষিত আত্মা তৃপ্ত হতো না। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুবের বিদায়, আগরতলা মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর আসলো ৭০-এর নির্বাচন। খালেদ সাহেবও সে নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে প্রার্থী হয়ে গেলেন। কারণ তাঁর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সহপাঠী, বন্ধু ও নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়েছিলেন তিনি নির্বাচন করুন, সেজন্য তাঁকে মনোনয়নও দিয়েছিলেন মুসলিম লীগের জাঁদরেল প্রার্থী ফকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
৬২ থেকে একের পর এক ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে বন্দরনগরীর তটভূমিতে, সে আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশনের জন্য একটি দৈনিক পত্রিকার প্রয়োজন ছিলো। খালেদ সাহেব সেটা বুঝেছিলেন, হাওয়া যেদিকে যাচ্ছে, তিনি সেদিকেই ভাসিয়ে দিলেন আজাদীর তরী। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী জাফরুল ইসলাম (এই ছাত্রনেতা সামরিক শাসনামলে আজাদীতে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হন) ছাত্রশক্তি নেতা নূরউল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা এম এ মান্নান, আবদুর রউফ খালেদ, ফেরদৌস কোরেশী, শহীদ মুরিদুল আলম ও কফিল উদ্দিন, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পীরজাদা খায়ের উল বশর (ড. রশীদ আল ফারুকী), ছাত্রশক্তি নেতা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান ও হারুনুর রশীদ খান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এএমএম শহীদউল্লাহ ও নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা আবু ছালেহ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহবুবুল আলম তারা ও বদরুল কামাল, ছাত্রলীগ নেতা প্রফেসর শায়েস্তা খান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আশরাফ খান ও ইদরিস আলম, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা দীপা দত্ত ও আবদুল্লাহ আল নোমান, ছাত্রলীগ নেতা মির্জা আবু মনসুর ও এসএম ইউসুফ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবু তাহের মাসুদ ও মোহাম্মদ মুসা, ছাত্রলীগ নেতা মৌলভী সৈয়দ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তখন নবজাগ্রত ছাত্র সমাজের নয়নমণি, ছাত্র রাজনীতির নায়ক-তাদের রাজনীতি ও আন্দোলনের বার্তা বহন করে আজাদী হয়ে উঠেছিলো জনগণের মুখপত্র। খালেদ সাহেব ছিলেন তলে তলে রাজনীতিরই মানুষ। কিন্তু সাংবাদিকতার কারণে সেটা প্রকাশ করা শোভন নয় বলে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাকে অন্তরে চেপে রাখতেন তিনি। পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইউসুফ চৌধুরী খালেদ সাহেব সম্পর্কে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ফজলুল কাদের চৌধুরীর একটা মজার মন্তব্য আমাকে বলেছিলেন। মনে হচ্ছে সেই কথাটা এখানে বলা যেতে পারে। ইউসুফ সাহেব বললেন, ফজলুল কাদের চৌধুরী নাকি তাঁকে বলেছিলেন যে, খালেদের কাণ্ড দেখছনি। তার পিতা হাদী সাহেব তাঁর কাছে থাকা নগদ টাকা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেন। খালেদের ভাগে পড়েছিলো আড়াই হাজার টাকা। বাপের টাকাগুলি কোথায় রেখে দেবে কোন ভালো কাজের জন্য। তা’ না করে খালেদ সেগুলি নিয়ে তাদের বাড়ির সামনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে চায়ের দোকানে বসে খেয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে।
এটা সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকের কথা, যখন খালেদ সাহেব মুসলিম লীগ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। এ কারণে তাঁর ওপর ফকা চৌধুরীর একটু রাগ থাকারই কথা। ফকা চৌধুরীর রাগের কারণ খালেদ সাহেব আর তাঁর বন্ধুরা তখন রাউজানে ফকা চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ করে আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। খালেদ সাহেবের বন্ধুদের সম্পর্কে আমি ডা. জাকেরিয়া চৌধুরীর কাছে জেনেছি। তাঁরা হলেন-ডা. সাহেব নিজে, সাধন ধর, লন্ডন শামসু- খ্যাত ডা. শামসুল আলম (তাঁরই পুত্র কানাডা প্রবাসী আবদুস সালাম ইউনেস্কোর কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন জানিয়েছিলেন), নুরু মিয়া মাস্টার।
খালেদ সাহেব ও তাঁর বন্ধুরা রাউজান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরা প্রত্যেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাদের ব্যক্তিগত প্রভাবও ছিলো। যে কারণে ফকা চৌধুরী তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন নি। না হলে সে সময় ফকা চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ করে রাজনীতি করা সহজ কাজ ছিলো না। তবে তাদের প্রতিষ্ঠিত সেই আওয়ামী লীগই ফকা চৌধুরীকে সত্তরে পরাজিত করে তাঁর রাজনীতিক জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলো। খালেদ সাহেব যখন গ্রামে ছিলেন, তখন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘ঝানু সংসদ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ সংগঠন থেকে তাঁরা নাটক মঞ্চায়ন সহ বিভিন্ন সমাজগঠনমূলক কাজ করতেন।
৭০-এর নির্বাচনে আর রাখঢাক নয়, খালেদ সাহেব এবার সরাসরি রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেন। নির্বাচনে তাঁর মোকাবেলা হয়েছিলো ডাকাবুকো মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগ সভাপতি ফকা চৌধুরীর সঙ্গে। ফকা চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর এটা প্রথম মোলাকাত ছিলো না। ১৯৫৬ সালেও একবার দু’জনের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই হয়েছিলো। কিন্তু খুব কম ভোটে হেরে যান খালেদ সাহেব। ৬২ সালেও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে খালেদ সাহেবকে কপের প্রার্থী করা হয়েছিলো। কিন্তু সেবার তার প্রস্তাবক ও সমর্থককে হাইজ্যাক করার ফলে তাঁর মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর জমে নি।
চট্টগ্রামে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটিতে খালেদ সাহেবের থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বঙ্গবন্ধুর বন্ধু এবং খালেদ সাহেবেরও বন্ধুস্থানীয় এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, ডা. শামসুল আলম, শেখ মোজাফফর আহমদ-রা চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। খালেদ সাহেব কলকাতার ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ও বন্ধু। সুতরাং এদের নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে খালেদ সাহেব ছিলেন না এমন হতে পারে না। পরে আমরা অধ্যাপক খালেদকে চট্টগ্রাম সদর উত্তর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেখি।
৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিজয়ী হবে তার পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছিলো, কিন্তু বঙ্গবন্ধু চিন্তিত ছিলেন ফকা চৌধুরী ও মৌলভী ফরিদের আসন নিয়ে। তাঁর দলের প্রার্থীরা ওই দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারছে কিনা সেদিকে উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। দু’জনের মধ্যে আবার ফকা চৌধুরীর দিকেই ছিলো বেশি নজর। কারণ পাকিস্তান জোড়া তাঁর নামধাম এবং মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন রাফ ও টাফ। খালেদ সাহেবের বিজয় এবং ফকা’র পরাজয়ই ছিলো ৭০-এর নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক।
নির্বাচনে বিজয়ের পর খালেদ সাহেবের জীবনের রাজনৈতিক দিকটা বড় হয়ে সামনে চলে আসলো। ৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার সকল এমএনএ, এমপি-এ এবং শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পাঁচজনের এই সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। অন্যরা হচ্ছেন-জহুর আহমদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী, এমএ হান্নান ও এমএ মান্নান। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে অধ্যাপক খালেদ ভারতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নানা দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম নীতি নির্ধারক এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের প্রকাশনা ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তিনশ’জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্য থেকে ৩৪জন বিদ্বান সদস্যকে সংবিধান তৈরির দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো। তন্মধ্যে আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক খালেদকে তাঁর বিদ্যাবত্তার জন্য বেছে নিতে অসুবিধা হয়নি। বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে তিনি এবং অধ্যাপক নুরুল কালাম চৌধুরী ওই কমিটির সদস্য ছিলেন।
৭৩ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭০-এ যাঁরা মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে ৭৩-এ মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কারণ তাদের পারফরমেন্স। শুধু যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ এবং সততার সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে অবদান রাখেন, ত্রাণ সামগ্রী বন্টনে দুর্নীতির আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেন নি, তাদেরকে দ্বিতীয় বারের মতো মনোনয়ন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, এমএ ওহাব ৭৩ সালেও আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও সম্ভবত পেয়েছিলেন।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেজন্য বিভিন্ন জেলায় বাকশালের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বাকশালের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তারপরের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার; দেশের প্রেসিডেন্ট ও জাতির জনককে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট রাতের অন্ধকারে কাপুরুষোচিত উপায়ে বিপথগামী সেনা সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনায় নরম মনের মানুষ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এতই ব্যথিত হন যে, তিনি রাজনীতির প্রতি আস্থা ও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। ক্রমশ নিজেকে রাজনীতির বৃত্ত থেকে দূরে সরিয়ে নিতে নিতে এক সময় আবার সাংবাদিকতা এবং সমাজ গঠন ও মানবসেবায় নিজেকে ডুবিয়ে দেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এই সময় শিক্ষাব্রতী, মানবপ্রেমী ও জনসেবকরূপে আবির্ভূত হন। তাঁর এই নতুন রূপ চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত হিতকর ও শুভকর প্রমাণিত হয়েছিলো। তাঁর মঙ্গলময় সত্তার আবির্ভাবে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো সমগ্র চট্টগ্রামে। তাঁর সফেদ পাজামা ও আজানুলম্বিত পাঞ্জাবী, পাকা চুল দাড়ি গোঁফ শোভিত মুখমণ্ডলে স্বর্গীয় হাসি এবং পাকা সাদা চুলে আবৃত মস্তকোপারি ততোধিক সাদা টুপি রাস্তায় চলমান অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে দেখে দেবদূত বলেই ভ্রম হতো দর্শনধারীর। সরল অন্তর থেকে শিশুর মতো যে নির্মল হাসি তিনি উপহার দিতেন, তাতে তাঁকে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে করা অস্বাভাবিক ছিলো না।
এই সময় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ মানবসেবায় নিজেকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। শহরে প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠান হয়; সবাই তাঁকে কাছে পেতে চায়, সে বিয়ে শাদী, মেজবান, অন্নপ্রাসন যাই হোক না কেন; তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করাতে চায় তাদের নতুন প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক উদ্যোগ কিংবা নবনির্মিত আবাস। কাউকে না করতে পারেন না খালেদ সাহেব, ফলে প্রতিদিন ডজন খানেক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি বা উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমন খবর ও ছবিতে পত্রিকার পাতা ভরে যেত।
শেষ জীবনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ব্যক্তিজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের মুরুব্বি বা অভিভাবক রূপে তিনি সকলের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। নিজের জীবনকালে যেমন প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন শেখ-এ-চট্টগ্রাম কাজেম আলী মাস্টার, চান্দ মিয়া সওদাগর; ব্যারিস্টার জেএম সেনগুপ্ত, আবদুল হক দোভাষ, শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, নূর আহমদ চেয়ারম্যান, এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী, তেমনি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদও তাঁর জীবিতকালে চট্টগ্রামের প্রবাদ পুরুষে পরিগণিত হয়েছিলেন।
বহু সার্বজনীন উদ্যোগ, প্রতিষ্ঠান অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পৌরহিত্য না করলে কখনো সাফল্যের মুখ দেখতো না। তাঁকে নিয়ে শুরু না করলে অনেক বারোয়ারি মাঙ্গলিক কর্মযজ্ঞ শুরুতেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে সভাপতি করে আন্দোলন না করলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড হতো না; অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে সভাপতি করে চট্টগ্রাম রোগী কল্যাণ সমিতি গঠন না করলে তা’ সফল হতো না। ভালো মানুষ ক্যাপ্টেন বখতিয়ারের সুযোগ্য সন্তান রোসাঙ্গীর বাচ্চু রোগী কল্যাণ সমিতি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবার জন্য করোনা ভ্যাকসিন
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল