প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মক্কা বিজয় ও নবী পাক (স.)’র সতর্কতা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল্লাহর নবী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,‘আমি যে আল্লাহর রাসূল এতে কি তোমার সন্দেহ আছে?’ শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করেছিলেন। আল্লাহর নবী তাকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। সে এক সময় প্রকৃত ঈমানদার হয়েছিল। ইসলামের পক্ষে সে যুদ্ধেও গমন করেছে। তায়েফের যুদ্ধে তার একটা চোখ আহত হয়েছিল। ইয়ারমুখের যুদ্ধে সে চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন বর্ণনায় উল্লেক করা হয়েছে,হযরত আব্বাস (র.) আল্লাহর নবীর কাছে সুপারিশ করেছিলেন,হে আল্লাহর রাসূল! আবু সুফিয়ান একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আপনি যদি আজ তাকে অনুগ্রহ না করেন তাহলে তার মর্যাদা থাকে না।’
নবী পাক (স.) বললেন,‘অবশ্যই আমি আজ তাকে মর্যাদা দিব।’ তারপর তিনি আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন,তুমি গিয়ে ঘোষণা করে দাও, যে ব্যক্তি কা’বায় আশ্রয় লাভ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি গৃহের দরজা বন্ধ রাখবে,সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে থাকবে,সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।’
তদানীন্তন আরবে কারও বাড়িকে নিরাপত্তার স্থান হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার অর্থ ছিল, তাকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করা। আল্লাহর নবী আবু সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তাই করেছিলেন। আবু সুফিয়ান পবিত্র মক্কায় গিয়ে আল্লাহর নবীর ঘোষণা জানালেন। তাঁর ঘোষণা শুনে মক্কার কুরাইশরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। তিনি আরও ঘোষণা দিলেন,‘ আজ থেকে আমি তোমাদের নেতা নই,আমার পরিচয় শোন,আমি মুসলমান।’
তাওহিদের সেনাবাহিনী পবিত্র মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকল। আল্লাহর নবী তাঁর প্রিয় চাচা আব্বাসকে বললেন,‘ আবু সুফিয়ানকে উচ্চস্থানে দাঁড় করিয়ে দাও, তাওহিদের সেনাবাহিনীর রূপ ও দৃশ্য সে দেখুক।’
নবী পাক (স.) সৈনিকদের নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন,কুরাইশরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কেউ আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করল, কেউ পবিত্র কা’বাঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কয়েকজন পবিত্র মক্কা ত্যাগ করে পালিয়ে গেল। হযরত আব্বাস নওমুসলিম আবু সুফিয়ানকে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। তাওহিদের বিশাল বাহিনী সমুদ্রের তরঙ্গের মত পবিত্র মক্কা নগরীতে আছড়ে পড়ল।
এক বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারণা হল। আরবের বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজের গোত্রের পতাকা উড়িয়ে মক্কা মোকাররমা নগরীতে প্রবেশ করছে। আল্লাহু আকবর ধ্বনীতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আল্লাহর সৈনিকেরা বীরদর্পে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বপ্রথম গিফরী গোত্রের মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার পেছনে জুবায়না গোত্র। মহান আল্লাহ হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ‘ফতহুম মুবিন’ অর্থাৎ প্রকাশ্য বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আজ তার বাস্তব অবস্থা মানুষ দেখতে পাচ্ছে। এরপর বিভিন্ন গোত্রের মিছিল বজ্রকণ্ঠে তাওহিদের ধ্বনীতে পবিত্র মক্কা প্রকম্পিত করে এগিয়ে গেল। নওমুসলিম আবু সুফিয়ান এসব জান্নাতী দৃশ্য দেখতে দেখতে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ছিলেন নবী পাক (স.)’র চাচা হযরত আব্বাস (র.)। কারণ সে দিন তার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তার উপর। তিনি চিনতে পারছিলেন না, কোনটা কোন বাহিনী। হযরত আব্বাসকে বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয় তিনি জিজ্ঞাসা করছিলেন। এগিয়ে এল বিশাল এক মিছিল নিয়ে সেনাপতি হযরত ইবনে উবায়দা (র.)। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন,‘এই বিশাল বর্ণাঢ্য বাহিনী আবার কোন বাহিনী? হযরত (র.) বললেন,‘এই বাহিনী মদিনার আনসারদের বাহিনী।’
হযরত উবায়দা দেখলেন আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন হযরত আব্বাসের সাথে। তাকে দেখে তিনি বললেন,হে আবু সুফিয়ান! আজকের দিন রক্তপাতের দিন। কা’বাকে আজ উম্মুক্ত এবং বৈধ করে দেওয়া হবে।’
অর্থাৎ আজ কা’বা এলাকায় রক্তপাত করা বৈধ। আবু সুফিয়ান বুঝলেন, আজ পবিত্র মক্কা নগরীতে রক্তের প্লাবন বইয়ে দেওয়া হবে। তিনি শংকিত হয়ে পড়লেন। তাহলে তার আত্মীয়-স্বজন এবং পবিত্র মক্কার অধিবাসীরা কেউ আজ জীবিত থাকবে না? এমন সময় তিনি দেখলেন, নবী পাক (স.)কে পরিবেষ্টন করে সাহাবায়ে কেরাম মিছিল করে মক্কা মোকাররমা নগরীতে প্রবেশ করছেন। এই মিছিলের পতাকা ছিল হযরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম (র.)’র হাতে।
আবু সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বললেন,‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি শুনেছেন, উবায়দা কি বলে গেল!’ আল্লাহর রাসূল জানতে চাইলেন,‘কি বলেছে উবায়দা?’ আবু সুফিয়ান জানালেন,‘উবায়দা বলে গেল আজকের দিন রক্তপাতের দিন।(পবিত্র) কা’বাকে আজ উম্মুক্ত এবং বৈধ করে দেওয়া হবে।’
নবী পাক (স.) তাঁকে অভয় দান করে বললেন,‘উবায়দা ভূল বলেছে। আজ (পবিত্র) কা’বার মর্যাদা দানের দিন।’ অর্থাৎ কোন রক্তপাত নয়, কা’বাঘরের প্রকৃত যে মর্যাদা, আজ সেই মর্যাদা দানের দিন।’
এরপর তিনি নির্দেশ দিলেন,‘উবায়দার হাত থেকে পতাকা নিয়ে তা যেন তাঁরই সন্তানের হাতে দেওয়া হয়। পবিত্র মক্কা নগরীতে এক পথ ধরে মিছিল প্রবেশ করেনি। বিভিন্ন পথ ধরে মিছিল প্রবেশ করছিল। হযরত খালিদ (র.)’র নেতৃত্বে একটা বিশাল মিছিল নগরীতে প্রবেশ করছিল।
বোখারী শরীফে এসেছে বিজয়ী বীর নবী পাক (স.),যাকে এই নগরীর লোকজন কতই না অত্যাচার করেছে,নামাজে দাঁড়ালে মাথার ওপর পশুর পচা নাড়িভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছে। নবী পাক (স.) মাথা উঠাতে পারেননি। শিশু ফতেমা পিতার এই করুণ অবস্থা দেখে কেঁদেছেন আর হাহাকার করেছেন। নবী পাক (স.)কে পথে বের হতে দেয়নি। তাঁকে পাগল বলে ঢিল ছুঁড়েছে। রান্না করতে দেয়নি। রান্নার হাঁড়িয়ে আবর্জনা নিক্ষেপ করেছে। এত অত্যাচার যারা করেছে,তাদের ভিতরে তিনি বিজয়ী বেশে প্রবেশ করছেন।
অথচ তাঁর চেহারায় গর্ব অহংকারের কোন চিহ্ন নেই। তাঁর সমস্ত আচরণে ক্ষমা আর ক্ষমা এবং মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। সুললিত কণ্ঠে তিনি ঐ সূরা ফাতহ্‌ তেলাওয়াত করছেন। যে সূরায় বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় নাজিল হয়েছিল। ইসলাম তরবারির শক্তিতে আসেনি। এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন,ইসলাম কোন শক্তির বিনিময়ে বিজয়ী লাভ হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফ্‌ফাল (র.) বলেন,আমি পবিত্র মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রাসূলকে উটের ওপর বসে মিষ্টি কণ্ঠে সূরা ফাতহ পাঠ করতে দেখেছি। হযরত মুআবিয়া ইবনে কুবরা বলেন, যদি আমার পাশে লোকজন ভীড় করার আশংকা না থাকত,তাহলে মুগাফ্‌ফালের মত আমিও রাসূলের তেলাওয়াত শুনতাম। (বোখারী)
আল্লাহর নবীর নির্দেশ ছিল, কোন ধরনের বাধা না এলে কারও প্রতি আঘাত করা যাবে না। কিন্তু কুরাইশদের একটা হঠকারী দল হযরত খালেদ (র.)’র মিছিলের ওপর আক্রমণ করে বসল। তিনজন সাহাবা শাহাদাত বরণ করলেন। বাধ্য হয়ে খালেদ (র.) হামলা করলেন। কুরাইশদের বিভ্রান্ত দলের ১৩ জন নিহত হল। আল্লাহর নবী দূর থেকে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে হযরত খালেদকে তলব করলেন। কৈফিয়ত চাইলেন,কেন যুদ্ধ শুরু করা হল। তিনি জানালেন,প্রতিপক্ষ তাদের ওপরে প্রথম আক্রমণ করে তিনজনকে শহীদ করে দিয়েছে। তখন আল্লাহর নবী বললেন,‘আল্লাহর ইচ্ছা এমনই ছিল।’
নবী পাক (স.)’র পতাকা হাজুন নামক স্থানে বসানো হল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল,‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আজ কোথায় থাকবেন? আপনি কি আপনার সেই পুরানো বাড়িতেই থাকবেন? আল্লাহর রাসূল বললেন,‘আকীল কি কোন জায়গা রেখেছে?’তারপর তিনি বললেন,‘ঈমানদার ব্যক্তি কাফেরদের উত্তরাধিকারী হয় না। আর কাফেরও ঈমানদারের উত্তরাধিকার হয় না।’(বোখারী)
ইসলামী আইনে কোন মুসলমান কোন অমুসলিমের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। আল্লাহর নবীর চাচা তালিব যখন ইন্তেকাল করেছিলেন,সে সময় হযরত আলির ভাই আকীল অমুসলিম ছিলেন। তিনি আল্লাহর নবীর এবং তাঁর পিতার সমস্ত সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। নবী পাক (স.) কা’বার ওই স্থানে অবস্থানের কথা বললেন, যেখানে ইসলাম বিরোধীরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য একত্রিত করে শপথ গ্রহণ করত। তিনি মক্কা মোকাররমা বিজয়ের সময় পবিত্র মক্কার উচ্চ এলাকা কাদা নামক স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যে উটে বসেছিলেন, তাঁর পেছনে বসেছিলেন মুতার যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত হযরত যায়িদ ইবনে হারিসার সন্তান হযরত উসামা (র.)। নবী পাক (স.) পবিত্র মাথা মোবারকে এ সময় ছিল লোহার শিরস্ত্রাণ। আল্লাহর নবী বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। এ কারণে তিনি উটের ওপরে আল্লাহর কাছে এতই কৃতজ্ঞশীল ছিলেন যে,তিনি মাথা নীচু করেছিলেন। তাঁর পবিত্র মাথা এতটাই নীচু হয়েছিল যে,তাঁর পবিত্র দাড়ি মোবারক উটের শরীরের সাথে স্পর্শ করছিল।
আহা! ওই বিলালের ওপরে কি নিষ্ঠুর নির্যাতনই না করেছে মক্কা মোকাররমা নিষ্ঠুর কাফেররা। তাঁর পবিত্র শরীরের গোস্ত আর রক্ত পবিত্র মক্কার পথে প্রান্তরে ছিটকে পড়েছে। তিনিও নবী পাক (স.)’র সাথে আছেন। কিন্তু তাঁর মনেও নেই কোন প্রতিশোধের সামান্যতম ইচ্ছা। সাহাবায়ে কেরামের চোখে মুখে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন। গোটা বিশ্বের কোন নেতা বা কোন বিজয়ী বাহিনীর এমন কোন ইতিহাস নেই,তারা বিজিত এলাকায় ক্ষমা আর করুণার মালা নিয়ে প্রবেশ করেছে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম নবী পাক (স.) এবং তাঁর অনুসারীরা। ক্ষমা আর করুণার সাগরে প্রাণের শত্রুও অবগাহন করেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসুফিবাদের উপর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা