দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভালোয় ভালোয় আমাদের ইমিগ্রেশন হয়ে গেল। আমরা একেকজন একেক অফিসারের সামনে নিজেদের পাসপোর্ট দিয়েছিলাম। আর প্রায় একই সময়ে আমাদের সকলের পাসপোর্টে সীল দেয়া হলো। নির্ঝঞ্ছাটভাবে ইমিগ্রেশন ডেস্ক পার হওয়া বেশ স্বস্তির একটি ব্যাপার। বিশেষ করে মোড়লদের দেশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ইমিগ্রেশন যেখানে নানা ঝক্কির সৃষ্টি করে সেখানে চীনের মতো দূরদেশে অনায়াসে পার হতে পারা আনন্দেরও বটে। আমি বেশ খোশমেজাজে সামনের দিকে হাঁটছিলাম। লায়ন ফজলে করিম লিটন আমাদের পুরো গ্রুপটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী লায়ন আবদুল বারেক, শরিফুল আলম, ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মঈনুদ্দীনসহ হাঁটছি আমরা। ইমিগ্রেশন ডেস্ক পার হয়ে লাগেজ বেল্টের দিকে যেতে হবে। লাগেজ বেল্টের ব্যাপারে ডিরেকশন দেয়া আছে। আমাদের ডিরেকশন দেখার দরকার ছিল না। লায়ন ফজলে করিম যেপথে যাচ্ছেন আমরাও অনায়াসে সেই পথ মাড়াচ্ছি। মনে মনে ভাবছিলাম যে, ইমিগ্রেশনের মতো লাগেজগুলোও ভালোয় ভালোয় পেয়ে গেলে ঝামেলা মিটে। লাগেজ নিয়ে জীবনে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। বিভিন্ন সময় আমার লাগেজ অন্যদেশে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আমি মালয়েশিয়ায় গিয়েছি, লাগেজ চলে গেছে সিংগাপুরে, আবার আমাদের ফ্লাইট প্যারিস যাচ্ছিল লাগেজ গিয়ে নেমেছে জার্মাণীতে! অপর এক ঘটনায়তো চিংড়ি ভাজা শুদ্ধ লাগেজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তিনদিন পর সেই লাগেজ উদ্ধার হয়েছিল। তবে চিংড়ি ভাজার কি অবস্থা হয়েছিল কে জানে! অবশ্য সিঙ্গেল রুটের জার্ণিতে এই ধরনের সমস্যা খুব একটা হয়না। ট্রানজিট ফ্লাইটে এক দেশের লাগেজ অন্যদেশে চলে যাওয়ার আশংকা প্রবল থাকে। বুকিং এর সময় সামান্য ভুলের জন্য, কিংবা লাগেজ লোড দেয়ার সময় একটু হেয়ালীর জন্য এক ফ্লাইটের লাগেজ অন্য ফ্লাইটে তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটে। সিঙ্গেল রুটে লাগেজ বেপথে দৌঁড়ানোর সুযোগ খুব একটা থাকে না। তবে এই ধরনের ফ্লাইটে আস্ত লাগেজ গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সৌদি আরব থেকে হজ্ব করে ফেরার সময় নানা জনের ‘চালানী’ নিয়ে আসছিলাম দেশে। ঢাকায় ভালোয় ভালোয় অবতরণ করলেও পরে দেখা যায় সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আমার লাগেজ ছাড়াই চলে এসেছে। পরবর্তীতে দুই দফায় ঢাকায় গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও ওই লাগেজের হদিশ আর মিলেনি। উল্টো যারা ‘চালানী’ দিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ ‘আমি মেরে দিয়েছি’ মনে করে বেজায় মন খারাপ করেছিলেন!
ওরে বাব্বা! এতো লাগেজ এরিয়া নয়, মনে হলো বড়সড় একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বিশাল এলাকা জুড়ে বেল্ট আর বেল্ট। অনেকগুলো বেল্ট ঘুরছে, আবার অনেকগুলো থেমে আছে। ফ্লাইট থেকে নামার সময় আমাদের লাগেজ কত নম্বর বেল্টে থাকবে তার ঘোষণা দিয়েছিলেন পাইলট। আবার লাগেজ বেল্ট এরিয়াতে মনিটরে কোন ফ্লাইটের লাগেজ কোন বেল্টে দেয়া হয়েছে তা ডিজিটাইল ডিসপ্লে করা হচ্ছিল। এতে করে লাগেজ বেল্ট খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ হয়ে উঠে। আমরা নির্দিষ্ট বেল্টে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পুলিশের গাড়ির (ইদানীং কিছু নব্য ধনীও গাড়িতে ব্যবহার করে) মতো লাল নীল বাতি জ্বলে আমাদের বেল্ট লাগেজ রিসিভের সিগন্যাল দিল। আমরা নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। পুরো আয়োজনটি বেশ চমৎকার। প্রত্যেকটি লাগেজ প্রথমে গর্তের ভিতর থেকে কই মাছের মতো লাফ দিচ্ছিল, অতপর বেল্টের উপর পড়ে ঘুরতে শুরু করছিল। এমন ব্যবস্থা আর কোথাও দেখেছি কিনা মনে করতে পারছিলাম না। তবে এক একটি লাগেজের কই মাছের মতো লাফ দেয়ার বিষয়টি বেশ সুন্দর লাগছিল। প্রতি মিনিটে কয়েকটি করে লাগেজ গর্তের ভিতর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেল্টে পড়ছিল কিন্তু আমাদের লাগেজের কোন হদিশ মিলছিল না।
হুররে, আমার লাগেজ লাফ দিয়েছে। ঠিক যেন লাল কই। আমার ট্রলিব্যাগটির রং লাল। ইউরোপের কোন এক দেশ থেকে কেনা। বেশ শক্ত। এতে করে লাফ দিলেও ভয়ের কিছু নেই। জিনিসপত্র কিংবা ব্যাগের ক্ষতি হওয়ার আশংকা জিরো পারসেন্ট। আমি বেল্টের উপর থেকে লাগেজটি টেনে নিয়ে ট্রলিতে রাখলাম। একে একে আমাদের সবার লাগেজ চলে আসলো। কোন লাগেজ হারানোর ঘটনা ঘটলো না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমরা প্রত্যেকেই একটি করে লাগেজ ক্যারিয়ার ট্রলি টেনে নিলাম। বেশ সুন্দর ট্রলি। ‘চীনা মাল’ নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে। ঠুনকো জিনিসপত্রকে আমরা অবলীলায় ‘চীনা মাল’ বলি। কিন্তু ট্রলিগুলো এত সুন্দর এবং মজবুত যে মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোন দেশ থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বিশ্বের কারখানা বলে খ্যাত চীন আর যাই করুক না কেন, নিজেদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্য দেশের ট্রলি রাখবে বলে আমার মনে হয়না। লাগেজ ক্যারিয়ার ট্রলিগুলো এত সাবলিল যে হাতের হালকা ছোঁয়ায় পথ চলছিল। আমাদের ঢাকা বিমানবন্দরের ট্রলির মতো গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলতে হচ্ছিল না। ট্রলি নিজে নিজে সামনে যাচ্ছিল, আমি শুধু স্টিয়ারিং এর মতো হাতলে হাত দিয়ে রেখেছিলাম। প্লাস্টিকের হাতল, কিন্তু কেমন যেন মোমের মতো নরোম মনে হচ্ছিল। ধরতেও আরাম, ছুঁতেও।
লায়ন ফজলে করিম লিটন আমাকে অন্য একটি ট্রলি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটিতে নিন। তারা কোথায় চলে গেছে বুঝতে পারবেন। এটিও লাগেজ ক্যারিয়ার ট্রলি, তবে ডিজিটাল ডিসপ্লে রয়েছে। রয়েছে জিপিএস সুবিধা। আপনি কোথায় যেতে চান, কোন পথে যেতে হবে তার জিপিএস সুবিধা দিয়ে দেয়া হয়েছে। কত নম্বর গেটে যাবেন তা ট্রলির ডিসপ্লেতে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। বহু ধরনের ট্রলি দেখেছি। বহু ট্রলি ব্যবহারও করেছি। মাগনায় ট্রলি, টাকা দিয়ে ট্রলি, ইউরো কিংবা ডলার দিয়ে ট্রলি ভাড়া করার সিস্টেমও রয়েছে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু এরূপ ডিজিটাল ট্রলি আর কোথাও কখনো দেখিনি। দেখলেও এভাবে খেয়াল করা হয়নি। স্কিনে মানচিত্র দেখে দেখে পথ চলছিলাম আমি। একই সাথে বেশ চমকিত হচ্ছিলাম। বেশ চমকিত!
চীনের গুয়াংজুতে ইমিগ্রেশন করলেও আমরা এখানে বের হবো না। আমাদের গন্তব্য সাংহাই। অভ্যন্তরীন রুটের ফ্লাইট ধরে আমরা প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের সাংহাই যাবো। ফ্লাইটে দুই ঘন্টারও বেশি সময় লাগবে। আমাদের টিকেট করা আছে, হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে সব আয়োজনই সম্পন্ন। তবে আপাতত আমাদেরকে ডোমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে নির্দিষ্ট ফ্লাইট অপারেটরের কাউন্টার খুঁজে নিতে হবে। ওখান থেকে যেতে হবে নির্দিষ্ট গেটে, যেখানে আমাদের পরবর্তী যাত্রার এয়ারক্রাফট অপেক্ষা করবে। বিশাল বিমানবন্দর, বিশাল ঝামেলা, পথঘাট ঠিকঠাকভাবে চিনে রাখা কঠিন, চিনে নেয়াও। কোন পথে গেলে যে ডোমেস্টিক টার্মিনালে যাবো তা করিম ভাই জানেন। তাই আমরা সবাই তাকে অনুসরণ করছিলাম। লাগেজ ক্যারিয়ার ট্রলি নিয়ে আনন্দে আছি আমি। কি যে আরাম ট্রলি চালাতে! আমাদের সাথে কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই। বাচ্চারা এই ধরনের ট্রলি পেলে গাড়ি বানিয়ে আনন্দ করতো। ছোটবেলায় রিঙা কিংবা সাইকেলের রিং নিয়ে যেভাবে মাইলের পর মাইল ছুটতাম, সেভাবে এই ট্রলি নিয়ে ছুটতে পারলে দারুণ হতো!
শুধু কি আমরা! শত শত মানুষ, নারী পুরুষ। কত দেশের কত জাতের কত মানুষ যে ছুটছেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে কারো হাতে যেন সময় নেই, সকলেই দৌড়ের উপর রয়েছেন। ইউরোপ আমেরিকাতেও মানুষকে এভাবে দৌড়াতে দেখেছি। যারা আমাদের মতো স্বাভাবিকভাবে আয়েশ করে হাঁটতেই পারেন না, সকলেই ছুটেন, সকলেই দৌড়ান। ঠাণ্ডার কামড় থেকে বাঁচতেই কি তারা এমন করে দৌড়ান? কিন্তু এখন তো তেমন কোন শীত নেই। তাছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিতরেও মিষ্টি মিষ্টি আবহ। এখানে এত ছুটাছুটি কেন কে জানে!
কত জাতের কত বর্ণের মানুষ যে ছুটছেন! কত্ত মানুষ! নারী পুরুষ শিশু কিশোর। কি সুন্দর সুন্দর মানুষ, কুচকুচে কালো মানুষ। পুতুলের মতো বাচ্চা! গাল টিপে দিতে ইচ্ছে করে! বিধাতার কি অপরূপ সৃষ্টি মানুষ! ‘বুঝলেন করিম ভাই, মানুষের চেয়ে সুন্দর কোন সৃষ্টি নেই। কিসের সপ্তম আশ্চর্য! মানুষের চেয়ে আশ্চর্য কোন সৃষ্টিও নেই।’ করিম ভাইকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললাম আমি। কিন্তু করিম ভাইর কোন উত্তর পেলাম না। পাশে ফিরে দেখি করিম ভাই নন, চ্যাপ্টা নাকের এক চীনা আমার পাশ দিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছেন।
আমাদের দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লায়ন ফজলে করিম লিটন, লায়ন আবদুল বারেক, শরিফুল আলম, হেলাল ইউ আহমেদ কিংবা আরিফ মঈনুদ্দীন ভাই কেউ আমার কাছে নেই। আমার সাথের কেউ নেই, অগুনতি মানুষের ভিড়ে আমি একদম একা। চারদিকে শত শত মানুষ, কিন্তু একজনও পরিচিত মানুষ নেই। আমার জন্য কেউ নেই। আমি কি হারিয়ে গেলাম!! এত বিশাল বিমানবন্দরে আমি দলের সঙ্গীদের কোথায় খুঁজবো! কোন পথে গেলে তাদের পাবো। আমার মনে হলো ইনফরমেশন ডেস্কে গিয়ে খবর নিই। পুরো বিমানবন্দরে সাউন্ড সিস্টেম রয়েছে। মাইকিং করতে পারলে করিম ভাই নিশ্চয় শুনবেন এবং আমাকে খুঁজে নেবেন। এখন আমি তাদের কোথায় খুঁজবো, তারাও বা কোথায় খুঁজবেন আমাকে! আমার অবস্থানই বা তারা জানবেন কি করে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেগম মুশতারী শফী : নারী প্রগতির অনন্য দীপশিখা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ