ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২৪ মার্চ, ২০২২ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে শিক্ষা ফোকাসের কেন্দ্রে ছিল

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর লগ্নে বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। সাড়ে সাত কোটি জনগণের এক কোটি তখন ফিরে আসছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে। তাদের ঘরবাড়ী ছিল বিধ্বস্ত, লুন্ঠিত কিংবা পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অগ্নি-সন্ত্রাসে পুড়ে ছারখার হওয়া ধ্বংসস্তুপ। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানো আরো দুই-আড়াই কোটি মানুষও তাদের ঘরবাড়ী পুনর্নির্মাণে এবং সংসার গুছিয়ে তোলার সংগ্রামে ছিল জেরবার। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ মানুষের পরিবারের যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁরাও ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত এবং শোকে পাগলপ্রায়। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, ১৯৭০ সালেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যঘাটতি প্রায় চল্লিশ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট, বন্দর ও রেলপথগুলো ছিল ধ্বংসযজ্ঞের শিকার। এই ভয়াবহ সংকট মোকাবেলায় সরকারের কোষাগার ছিল শূন্য, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ছিল পাকিস্তানীদের সুপরিকল্পিত লুন্ঠনের ফলে একদম খালি। দেশের প্রাইভেট সেক্টরের কলকারখানাগুলোর ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পাকিস্তানী নয়তো অবাঙালি। তারা পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ায় ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের আগেই। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল–এই ২৪ বছরের পুরো সময়টা জুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, লুন্ঠন ও অবিশ্বাস্য রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আক্ষরিকভাবেই ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করেছিল। (‘বেলুচিস্তান ও বাংলার কসাই’ সমরনায়ক টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল,‘মুঝে স্রিফ মিট্টি চাহিয়ে’)।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকার সংকট মোকাবেলার কঠিন সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের পর সম্প্রসারিত মন্ত্রীসভা গঠন করে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু এগুলোর সাথে যোগ করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই চারটি রাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে দেশের সংবিধান রচিত হলো। বঙ্গবন্ধু দেশের শ্রেষ্ঠ চারজন অর্থনীতিবিদদেরকে রাজি করালেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সদস্য হওয়ার জন্য। প্রফেসর নুরুল ইসলাম হলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সদস্য হলেন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান এবং প্রফেসর আনিসুর রহমান। কমিশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রফেসর এ আর খান, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ, ডঃ স্বদেশ রঞ্জন বোস এবং প্রফেসর শামসুল ইসলামের মত মেধাবী ব্যক্তিরা। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দিন এবং পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে শুরু হলো ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারী বাজেট এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। সরকারের দায়িত্বগ্রহণের অব্যবহিত পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির প্রথম স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ উদযাপনকে উপলক্ষ করে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত নীতিমালা ঘোষণা করলেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বাজেট ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে এদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১.১৬ শতাংশ সরকারী ব্যয়বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় শিক্ষাখাতে এত বেশি ব্যয়বরাদ্দ যে সরকারের জন্য কতবড় চ্যালেঞ্জ ছিল তা এখন চিন্তাও করা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনগণকে দ্রুত শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই যে উন্নয়নের মূল দর্শন হতে হবে সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সরকারের নীতি-নির্ধারকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ বাজেট ১৯৭৫-৭৬ অর্থ-বছরের বাজেটেও শিক্ষাখাতকে অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতাসীন সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতের সরকারী ব্যয়বরাদ্দকে টেনে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন থেকে পুরো জিয়া আমল এবং এরশাদ আমলে প্রতিরক্ষা খাতের সরকারী ব্যয়বরাদ্দ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮৩-৮৪ অর্থ-বছরে শিক্ষাখাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ ছিল বাজেটের মাত্র ৯.৬ শতাংশ। ২০০১-৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত কোয়ালিশন সরকারের সময় কয়েক বছর শিক্ষাখাতের সরকারী ব্যয়কে জিডিপি’র ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ঐ সময়ে শিক্ষাখাতের সরকারী ব্যয়-জিডিপি’র অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ছিল সর্বনিম্ন। আরো দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরসূরি দাবিদার বর্তমান সরকার নিজেদেরকে শিক্ষাবান্ধব সরকার বলে গলাবাজি করলেও চলমান ২০২১-২২ অর্থ-বছরে শিক্ষাখাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ জিডিপি’র ২.৩ শতাংশেই আটকে রয়েছে। গত ১৩ বছর ধরে এই অনুপাত জিডিপি’র ২.২ শতাংশ থেকে ২.৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেসকো বলছে জিডিপি’র ছয় শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত, বাংলাদেশও ঐ অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ।
১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষা সম্পর্কে অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে ১৭ নম্বর ধারায়, যা নিম্নরূপ:
”রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
উপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজী মিডিয়াম শিক্ষাকে ধাপে ধাপে মূল ধারার ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিক্যুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল তাতে ঐ বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরতে খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারী গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। ঐ রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫-১৯৯৬ এর ২১ বছরে কোন সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি। এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার কর্তৃক প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
এদেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। তালিকাটা দেখুন: ১) সরকারী প্রাইমারী স্কুল, ২) এঙপেরিমেন্টাল প্রাইমারী স্কুল, ৩) রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৪) নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৫) প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল, ৬) কমিউনিটি স্কুল, ৭) সেটেলাইট স্কুল, ৮) হাই স্কুলের সাথে সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল, ৯) এনজিও পরিচালিত স্কুল, ১০) কিন্ডারগার্টেন ও ১১) এবতেদায়ী মাদ্রাসা। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিতামাতার বিত্তের নিক্তিতে ওজন করে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারী বা বেসরকারী প্রাইমারী স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে এবতেদায়ী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে ‘লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে’ ভাতটা তো অন্ততঃ জুটলো! এভাবে সারা জীবনের জন্য ঐ শিশুকে বৈষম্যের অসহায় শিকারে পরিণত করে ফেলা তার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বড় হয়ে সে বাবা-মাকে অভিশাপ দেবে কিংবা পরিবারের দারিদ্র্যকে দোষ দেবে তাকে ভুল স্কুলে বা মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য, কিন্তু তখন আর ভুল সংশোধনের কোন উপায় থাকবে না। এর অপর পিঠে দেশে ইংরেজী মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যাবৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলা মাধ্যম প্রাইমারী স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে গত সাড়ে চার দশকে। এগারো ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকতে দেওয়া কি অসাংবিধানিক নয়?
শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো যুগোপযোগিতাহীন কারিক্যুলাম অনুসরণকারী হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসার নাটকীয় বিস্তার। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করায় গত ৪৭ বছরে এদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার, সৌদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল সম্পদের খুদ-কুঁড়া হিসেবে মাদ্রাসাগুলোতে যে বিদেশী খয়রাত প্রবাহিত হচ্ছে ঐ খয়রাতের বড় অংশটাই কওমী মাদ্রাসাগুলো আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু একইসাথে আবাসিক সুবিধা এবং আহারের ব্যবস্থা থাকে তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান–ইংরেজী মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মূল ধারার বাংলা মাধ্যম সরকারী স্কুল, বাংলা মাধ্যম বেসরকারী স্কুল এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। আমরা এখন ভুলে গেছি যে বঙ্গবন্ধুর আমলে একটিও নূতন ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়নি। বরং কুদরতে খুদা কমিশন ধাপে ধাপে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল, অথচ এখন উল্টো সারা দেশে ও লেভেল/এ লেভেল চালু হচ্ছে যত্রতত্র। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি!
বঙ্গবন্ধু দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে ঐ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর গত ৪৭ বছরে এদেশের আর কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন চালু করার পর প্রাইভেট সেক্টরে উচ্চশিক্ষা এখন মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজির লোভনীয় ক্ষেত্র এখন শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার এহেন বাজারিকরণ কি অসাংবিধানিক নয়? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী বলে দাবিদার বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ পুঁজিবাদী দর্শন অব্যাহত রেখে শিক্ষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারকে কি উপহাস করছে না?

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধবাথরুমের পাশে পড়ে ছিল গৃহবধূর লাশ