জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

ধরাধামে রাহমাতুল্লীল আলামীনের শুভাগমন

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহকে ভয় করুন, মহান প্রতিপালকের প্রশংসা করুন। যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রিয় নবীকে প্রেরণ করে অনুগ্রহ করেছেন। যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ বিশ্ববাসীকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বেরিয়ে এনেছেন।
জেনে রাখুন! আমাদের মহান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি সমগ্র নবী রাসূলগণের ইমাম। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সুমহান মর্যাদা বর্ণনায় অসংখ্য আয়াত অবর্তীণ করেছেন। যে গুলো তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। যেমন পবিত্র কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে, আমি আপনার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত:৪)
কলেমা, আযান, ইকামত, তাশাহুদ, খুতবা ইত্যাদি জিকরসহ প্রতিটি ইবাদতে আল্লাহ তাঁর নবীজির নাম মোবারক কে তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত করেছেন। নামাযের মধ্যে তাশাহুদের সময় তাঁর নবীজিকে সালাম দেয়াকে বান্দার উপর ওয়াজিব করেছেন। এরশাদ হয়েছে হে প্রিয় রাসূল! আমি আপনাকে চাক্ষুষ স্বাক্ষী ( হাজির নাযির), জান্নাতের সুসংবাদদাতা ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছি। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন। রাসূলকে সাহায্য করো, তাঁকে উচ্চমানের সম্মান প্রদর্শন করো এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর সালাত পাঠ করো। (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত নং ০৯)
এভাবে আরো এরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ, নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো, রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। (সূরা নিসা: আয়াত নং ৫৯)
হে মুমীনগণ! মহান প্রভূর আদেশ মান্য করুন। নবীজির প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করুন। নবী প্রেম অন্তরে ধারণ করে অন্তরাত্না আলোকিত করুন। কেননা হুব্বে রাসূল তথা নবী প্রেমই ঈমান। যার অন্তরে নবীজির মহব্বত নেই তাঁর ঈমান নেই। মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, হে হাবীব আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। (সূরা: আল-ইমরান, পারা: ৩, আয়াত নং ৩১)
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ মুমীন হতে পারবেনা যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সকল মানুষ থেকে প্রিয় হই। (বোখারী শরীফ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ০৭ এবং মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৪৯)
আল কুরআনের আলোকে রাসূলুল্লাহর শুভাগমন:
আল্লাহর নিকট হতে নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন। এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান।
(সূরা: মায়িদা, আয়াত: ১৫-১৬)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা অন্য আয়াতে আরো এরশাদ করেছেন, “তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। অপর সমস্ত ধর্মের উপর বিজয়ী করার জন্য, আর স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
(সূরা: ফাতহ: আয়াত: ২৮)
নবীজির পাঁচটি মহিমান্বিত নাম:
হযরত জুবাইর ইবন মুত্‌ঈম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার পাঁচটি নাম আছে, আমি মুহাম্মদ (প্রশংসিত), আহমদ (প্রশংসাকারী), আমি মাহি (মোচনকারী), আল্লাহ তা’য়ালা আমার দ্বারা কুফরী নিশ্চিহ্ন করবেন। আমি হাশির (একত্রিতকারী), সব লোককে কিয়ামত দিবসে আমার কদমের নিকট সমবেত করা হবে। আর আমি আকিব (সর্বশেষ আগমনকারী সর্বশেষ নবী) (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৩৩৩৯, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং :২৩৫৪)
আল্লাহর সর্ব প্রথম সৃষ্টি:
জেনে রাখুন! সরওয়ারে কায়েনাত হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্বসৃষ্টির মূল উৎস। সৃষ্টির রূহ। প্রখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ আল মাহদী আহমদ স্বীয় কিতার “মাতালিউল মুসিররাত” এ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃজন করেছেন, আমার নূর হতে প্রতিটি বস্তু সৃজিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন, সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রাণ এবং বিশ্বসৃষ্টির অস্তিত্বের রহস্য।
আরবের শ্রেষ্ঠ বংশে নবীজির শুভাগমন:
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ওয়াসেলা ইবন আসকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে বনু কেনানাহকে মনোনীত করেন, এবং তাদের মধ্যে কুরাইশকে এবং কুরাইশদের মধ্যে বনু হাশেমকে এবং আল্লাহ তায়ালা আমাকে বনু হাশেম থেকে মনোনীত করেছেন। (মুসলিম, হাদীস নং: ২২৭৬, তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৬০৫)
মিলাদুন্নবী মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত:
মিলাদুন্নবী ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক। ইসলামী সংস্কৃতির এক গৌরবময় ও বরকতময় আমল, হাজার বৎসর ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে এ ধারা আবহমান কাল থেকে প্রচলিত। যা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম ইবনে জওযী (৫১০-৫৭৯হি.) বর্ণনা করেন, সর্বদা মক্কা মদীনায়, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া, এমনকি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র আরববাসীরা মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মাহফিল আয়োজন করে আসছেন, রবিউল আউয়াল শরীফের নবচন্দ্র উদিত হলে তারা খুশী, আনন্দে উদ্বেলিত হয় এবং বিশেষ গুরুত্বসহকারে মিলাদ পাঠ ও শ্রবণের ব্যবস্থা করে থাকেন এতে তাঁরা অসংখ্য সওয়াব ও মহা সাফল্য অর্জন করে থাকেন। (আল্লামা ইমাম ইবনে জওযী ৫৭৯হি. কর্তৃক বিরচিত মীলাদুন্নবী)
সর্বদা মুসলমানরা রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী মাহফিল উদযাপন করে আসছে, তারা দান সাদকা, কল্যাণধর্মী কার্যক্রম ও খুশী উদযাপন করে থাকে। তারা ঐ দিন উত্তম পুণ্যময় কাজের চেষ্ঠা করে এবং নবীজির শানে মিলাদ পাঠের ব্যবস্থা করে থাকে। (মাছাবাতা বিস সুন্নাহ, পৃ: ৬০)
মিলাদুন্নবীর জুলুস মুসলিম ঐক্যের প্রতীক:
বিশ্ব মানবতার কাণ্ডারী, মুক্তির দিশারী, বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত, কল্যাণের মূর্ত প্রতীক, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধরাধামে শুভাগমনের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র রবিউল আউয়াল শরীফে নবীজির শুভ জন্ম দিন উদযাপনের স্মারক হিসেবে মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জশনে জুলুস তথা শোভা যাত্রা আয়োজন, নূর নবীজির আগমনে সম্মান প্রদর্শন ও মহান আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর। হিজরতে পাক্কালে নবীজি মদীনা মুনাওয়ারায় পদার্পন করলে “সানিয়্যাতিল বিদা” নামক স্থানে আনসার সাহাবা কেরামের প্রাণঢালা অভ্যার্থনা জ্ঞাপন, জশনে জুলুসের অভ্রান্ত দলীল ও ঐতিহাসিক ভিত্তি। যেমন হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফ থেকে মদীনা মনোওয়ারা পৌছলে নবীজিকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য মদীনার পুরুষ ও মহিলারা ঘরের ছাদে আরোহন করেন, মদীনার শিশু কিশোরেরা রাস্তার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন, সকলে সম্মিলিত ভাবে উচ্চস্বরে শ্লোগান দিতে থাকেন ইয়া মুহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া মুহাম্মদ ইয়া রাসুলাল্লাহ। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং : ২৩১১)
হে আল্লাহ! আমাদের কথায় কাজে কর্মে ও পবিত্র নিয়্যতে আপনার সন্তুষ্টি দান করুন। হে আমাদের অভিভাবক! নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার ভালবাসা ও আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসা নসীব করুন। আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন, কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা পরিত্রাণ নসীব করুন। নিশ্চয়ই তিনি দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পূণ্যময় অনুগ্রহশীল, দয়ালু, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
আবদুল মুকতাদির
বাহুলী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি যদি মসজিদে ভিক্ষা চায় তাকে কিছু দেওয়া জায়েজ আছে কিনা? শরয়ী দৃষ্টিকোনে মসজিদে ভিক্ষা করা বৈধ কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: কেউ ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া হারাম। এমন ভিক্ষুকদেরকে মসজিদে দান করা মাকরূহ। আল্লামা আলাউদ্দিন আলী হাস্কফী মৃ. ১০৮৮ হি. দুররে মোখতার কিতাবে বর্ণনা করেন, মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া হারাম। (ফাতওয়া শামী, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৮৮)
মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া থেকে বিরত থাকবে। যিনি দান করতে ইচ্ছুক তিনি মসজিদের বাইরে দান করবেন। (ওয়াকারুল ফাতওয়া, ২য় খণ্ড, পৃ: ২৬২), এভাবে প্রসিদ্ধ ফিকহর কিতাব “বাহারে শরীয়তে” উল্লেখ রয়েছে, মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া হারাম। এবং এ প্রকারের ভিক্ষুককে দান করা নিষিদ্ধ। মসজিদে হারানো বস্তু তালাশ করা নিষেধ। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যখন তোমরা মসজিদে হারানো বস্তু তালাশ করতে দেখবে তখন বলবে আল্লাহ যেন তোমাকে তা ফিরিয়ে না দেয়. মসজিদ এ জন্য নির্মিত হয়নি।
এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৮৩)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনে নিখোঁজ বা লাপাত্তা ব্যক্তি কে?
পরবর্তী নিবন্ধদুরের দুরবিনে