কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণিকেই ভালো থাকতে হবে

মানুষ ধরে নিয়েছিল পৃথিবী নামক গ্রহটি শুধুই মানুষের। মানুষের প্রয়োজনেই অন্য সবকিছু। পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ, নদী-নালা, জলাশয় ও অন্যান্য ততটুকুই থাকবে যতটুকু মানুষের প্রয়োজন। ফলে কোনোকিছু ধ্বংস করতে, বিপন্ন করে তুলতে মানুষ দ্বিধা করেনি।
মনে রাখা দরকার, পৃথিবীটা যে একটি গ্রহ এবং শুধু এই গ্রহেই, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে জীবের অস্তিত্ব আছে সে ধারণাটিও বেশি পুরনো নয়। তবে একসময় মানুষ নিজেদের জানাশোনা জগৎটাকেই বিশ্ব মনে করতো। এবং নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব মনে করে অন্য প্রাণিদের ভালো-মন্দ এমনকি তাঁদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেনি। ফলে তারা উজার করেছে বনজঙ্গল। বিনাশ করেছে প্রকৃতিকে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জন্য সংরক্ষিত এলাকাও মানুষের লোভ ও দখল থেকে রেহাই পায়নি। বনের পশুকে লোকালয়ে এনে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছে। বনের নির্জনতাকে ধ্বংস করে সেখানে তাদের আনন্দ-ফূতির্র জন্য আধুনিক রিসোর্ট নির্মাণ করেছে। বনের স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে আজব ধারণা ‘ইকোপার্ক গড়ে তুলেছে। মানুষের এই আচরণে ক্ষুব্ধ এক বঙ্গ সন্তানই লিখেছিলেন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এই বাণী তো আর বিশ্বময় প্রচার হয়নি কিন্তু হায় সে কথায় কর্ণপাত করেনি স্বদেশের মানুষ। ফলে এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে যে মহামারী চলছে তার উৎসও কোনো বন্যপ্রাণি বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু করোনা নয় নিপাহ ভাইরাসও বাদুড় থেকে ছড়ায় বলে প্রমাণ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়াও অতীতে পশুপাখি থেকে আসা জীবাণু বা রোগ বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। সেই তালিকায় আছে: অ্যানথ্রাঙ, জলাতঙ্ক, কিউ ফিবার, চ্যাগাস ফিবার, এ টাইপ ইনফ্লুয়েঞ্জা, রিফট ভ্যালি ফিবার, সার্স, মার্স, ইবোলা এবং এইচআইভি। এই তালিকায় সবশেষে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস।
দেখা যাচ্ছে এখন শুধু মানুষ সতর্ক বা নিরাপদ থাকলে চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে বনের পশুপাখির কথাও ভাবতে হবে। অর্থাৎ থাকলে সবাইকে ভালো থাকতে হবে। আর এসব কারণে কয়েকবছর ধরে ‘এক স্বাস্থ্য’ ধারণার সূত্রপাত হয়েছে। বলা হচ্ছে, পশুপাখি তথা প্রকৃতির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত থাকবে না। মানুষ, পশুপাখি ও প্রকৃতির স্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে, এই ধারণাই বৈশ্বিকভাবে ‘ওয়ান হেলথ’ বা ‘এক স্বাস্থ্য’ নামে পরিচিত হচ্ছে। এই ধারণার মূল কথা হচ্ছে, মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় তাই মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে তার স্বাস্থ্য অটুট রাখতে পারে না, পারবে না। মানুষের স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকবে, যখন বন্য প্রাণি, গৃহপালিত পশুপাখি, খামারের জীবজন্তু, কৃষিজমি এবং বৃহত্তর প্রতিবেশের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
এ লক্ষ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ জাতিসংঘের কিছু অঙ্গসংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির মতো আন্তর্জাতিক একাধিক দাতা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একাধিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এক স্বাস্থ্যের ধারণাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছে প্রায় দুই দশক ধরে। এ ধারণাটি খুবই চমৎকার ও সময়োপযোগী। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনসন (সিডিসি) বলছে, এক স্বাস্থ্য হচ্ছে বহুপক্ষীয় ও বহু খাতভিত্তিক সহযোগিতামূলক কর্মোদ্যোগ। এটি কার্যকর হবে স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে। মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের বসবাসের পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সবার স্বাস্থ্য ঠিক রাখাই এক স্বাস্থ্যের উদ্দেশ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে বিশ্বজুড়ে । নতুন বসতির জন্য জমি দরকার হচ্ছে। এ কারণে বন উজাড় হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণেও বন কমে আসছে। এসব কারণে জীবজন্তুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ বাড়ছে। পশুপাখি মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্য, চামড়া ও লোম, ভ্রমণ, খেলাধুলা, শিক্ষা এবং সংঘ লাভে পশুপাখির দরকার হয়। পশুপাখি ও তাদের পরিবেশের নিবিড় সংস্পর্শে গেলে তাদের রোগ মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। আবার পরিবেশ ও আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে পশুপাখির মধ্যে নতুন রোগ দেখা দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
গত তিন দশকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে নতুন যেসব রোগের বিস্তার ঘটছে অথবা পুরোনো যেসব রোগ আবার নতুন করে আবির্ভূত হচ্ছে, তার ৭৫ শতাংশ আসছে জীবজন্তু বা পশুপাখি থেকে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, বন্যপ্রাণি এবং কখনো কখনো গৃহপালিত প্রাণির সংস্পর্শে আসার প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধরনের রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
১ হাজার ৪৬১টি সংক্রামক রোগ পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস সমপ্রতি বলছে, এদের প্রায় ৬০ শতাংশের একাধিক বাহক আছে। এরা মানুষ, জীবজন্তু বা পাখির শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। অর্থাৎ কিছু রোগের জীবাণু পাখি ও পশু থেকে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
বিশ্ব এখন উন্মুক্ত। গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বায়নের এই যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। সড়ক ও আকাশপথে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। ভ্রমণ ও ব্যবসার কারণে মানুষের চলাচল বেড়েছে সে সঙ্গে বেড়েছে জীবজন্তু এবং পশুজ পণ্যের আদানপ্রদানও। সে কারণে যেকোনো সংক্রামক রোগের দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করার এবং বৈশ্বিকভাবে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়েছে।
একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ১৯টি নতুন রোগ ও পুরোনো রোগ নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ১৯৭৭ সালে এ দেশের মানুষ প্রথম ‘জাপানিজ এনকেফালাইটিস’ রোগে আক্রান্ত হয়। তার আগে মশাবাহিত এই রোগ দেশে ছিল না। এইচআইভি/এইডস, ডেঙ্‌গু, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, জিকা্তএসব রোগ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। সবশেষ নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে এ দেশে। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা বা ইউরোপের কোনো দেশে দেখা দেওয়া নতুন রোগ কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে চলে আসতে দেখা গেছে। কখনো সময় নেয় বেশি, কখনো কম। যেমন এইচআইভি/এইডস বৈশ্বিকভাবে আফ্রিকায় শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। ওই ভাইরাস বা রোগ বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। নিপাহ ভাইরাস মালয়েশিয়ায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। এর চার বছর পর তা বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। করোনাভাইরাস চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে। আড়াই মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ মার্চ তা বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানানো হয়। (সূত্র প্রথম আলো)
এর মধ্যে উদ্বেগজনক খবর হলো, অতীতের কিছু রোগ বাংলাদেশে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে ডেঙ্‌গু ও অ্যানথ্রাঙের মতো রোগ। এ বছরও ডেঙ্‌গুতে দেশে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এর মধ্যে ৭১ জন মারা গেছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী বছরগুলোতে ডেঙ্‌গুর মতো রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে ।
একটি বিষয় আমরা সাধারণ মানুষ হিসাব করি না বা তার সঠিক তথ্যটি জানি না। তা হলো, এসব রোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকটি। আইইডিসিআরের ২০১১ সালের এক হিসাব বলছে, ২০০৭ সালে দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু দেখা দেওয়ার পর তা দেশের ৫২টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় প্রায় ২৪ লাখ মুরগি মেরে ফেলা হয়েছিল। ফলে সপ সময় প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ২৫৮ কোটি আর সার্বিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে দেশের ১৫টি জেলায় গরুুছাগল অ্যানথ্রাঙে আক্রান্ত হয়। এই বছর ১২টি জেলায় ৬০৭ জন মানুষ অ্যানথ্রাঙে আক্রান্ত হয়েছিল। অ্যানথ্রাঙের প্রকোপ মাংস ও চামড়ার বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
এমন একটি মহামারী,এমন কিছু তথ্যের পরও আমাদের ভাবনার জগৎ কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতির প্রতি, পরিবেশের প্রতি, যদি আমরা যথাযথ আচরণ না করি তাহলে তার দায় আমাদের বহন করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই পৃথিবী যতটা মানুষের ঠিক ততটাই অন্য প্রাণির, উদ্ভিদের, তৃণের, পোকামাকড়ের। সবার পৃথিবীকে শুধু নিজেরা দখল করলে, ভোগ করলে তার মাশুল দিতে হবে কড়ায়-গণ্ডায়। প্রকৃতি সবার জন্য সমবন্টন করেছে। সেখানে গায়ের জোরে দখল নেওয়া যাবে বটে কিন্তু আখেরে তার চড়া দাম পরিশোধ করতে হবে যেমন এখন দিতে হচ্ছে। বাঁচলে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। ভালো থাকতে হলে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তৃতা স্মরণ করা যেতে পারে যদিও তাঁর বক্তব্যটি মহামারীর ভ্যাকসিন নিয়ে। ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়ার পর ধনী দেশগুলোর ‘ভ্যাকসিন পলিটিক্স নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, সুস্থ হলে সবাইকে সুস্থ হতে হবে। কোনো দেশকে বা কোনো অঞ্চলের মানুষকে অসুস্থ রেখে বিশ্ব করোনামুক্ত হবে না।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘যুক্ত করো হে সবার সাথে মুক্ত করো হে বন্ধ’
পরবর্তী নিবন্ধমৃত্যুশূন্য দিনে চট্টগ্রামে নতুন শনাক্ত ১৪