আজ থেকে ৭২ বছর আগে (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২), ভাষার জন্য জেল জুলুম মামলার শিকার হওয়া কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ভাষাসৈনিক ছাত্রদের পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। সেদিন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জাব্বাররা হয়েছিলেন ভাষাশহিদ। আর, ভাষা বীর ছিলেন সমগ্র দেশের অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ ছাত্র শিক্ষক এবং দেশপ্রেমী জনতা। তাঁদের কেউ কেউ পাকিস্তান সরকারের মামলার শিকার হয়ে কারাবরণও করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ঢাকার জাতীয় নেতা এবং ছাত্র নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ঐতিহ্যবাহী কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়(প্রতিষ্ঠা–১৯৩৩)’র চারজন ছাত্র নেতার নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসে। এঁরা হলেন স্কুলের নবমের ছাত্র সৈয়দ আবদুল মাবুদ (আমার মরহুম আব্বা, পশ্চিম ধলই, সফিনগর), আলম খাঁন চৌধুরী (পশ্চিম ধলই, মনিয়া পুকুর), অষ্টমের ছাত্র আবদুল লতিফ (ফটিকছড়ি) এবং নুরুল হুদা (সীতাকুণ্ড)। এঁরা ঢাকার ছাত্র নেতাদের সাথে একাত্ম হয়ে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ স্লোগান দিতে দিতে রেল স্টেশন ঘেড়াও করেন সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২‘র বেলা ১১ টার দিকে। সকাল ৯ টায় যে ট্রেনটি চট্টগ্রাম শহর থেকে ছেড়ে নাজিরহাট রেলস্টেশনে আসতো, সেটি আবার শহরের দিকে ফিরে যেত দুপুর ১২ টা নাগাদ। নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রাম শহরের দিকে ফিরতি ট্রেনটিকে কাটিরহাট রেল স্টেশনে আটকে রাখাই ছিল আন্দোলনকারী ছাত্রদের মূল উদ্দেশ্য। রেলগাড়ি নাজিরহাট ছেড়ে কাটিরহাট হয়েই যেতে হয় শহরে। তাই তাঁরা মিছিল করতে করতে কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নিকটের রেল স্টেশনে এসে জড়ো হয়েছিলেন। রেলগাড়িটি কাটিরহাট স্টেশন পৌঁছাবার আগে থেকেই তাঁরা রেললাইনে শুয়ে থাকেন কয়েকঘণ্টা। ফলে, ট্রেন শহরে পৌঁছে অনেক বিলম্বে। বিলম্বের কারণ সম্পর্কে জবাবদিহি করতে গিয়েই ছাত্রদের আন্দোলনের ঘটনাটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। হাটহাজারী থানা পুলিশ, উর্ধ্বতন রেল কর্তৃপক্ষসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নেতৃত্বদানকারী চারজন ছাত্রকে চিহ্নিত করা হয় এবং চট্টগ্রাম এসডিও‘র কোর্টে ফৌজদারি মামলা হয় এ চারজনের বিরুদ্ধে। প্রধান আসামি করা হয় সৈয়দ আবদুল মাবুদকে। সাথে সাথে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ধরপাকড়ও শুরু হয়ে যায় খুব জোরেশোরে। কাটিরহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদেরকে গ্রেপ্তার এড়াতে নানাভাবে সহায়তার প্রয়াস পান বটে। কিন্তু সরকারি চাপ, আর পুলিশের উপর্যুপরি ধাওয়া সামলোনা সম্ভব হবে না, এমনটা যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন স্থানীয় এক উকিলের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিনে আসেন তাঁরা।
জামিন পাবার পর মামলায় হাজিরা দিতে গেলেই লাগতো জনপ্রতি দশ টাকা হিসেবে মোট চল্লিশ টাকা উকিল ফি। আজ থেকে বাহাত্তর বছর আগে জনপ্রতি দশ টাকা জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ ছিল ছাত্রদের জন্য। বিশেষ করে সৈয়দ আবদুল মাবুদ ছিলেন পিতৃ–মাতৃহীন একদম অসহায় এতিম ছাত্র। একদিন হাজিরা দিতে গিয়ে উকিল সাহেবের ফিসের চাহিদা পূরণ করতে পারলেন না। তাই, এই উকিল সাহেব (মোখতার) ছাত্রদের জামিন প্রত্যাহার করে নেন। আসামিদের জামিন বাতিল করে দেওয়া হলো, তাঁদের পাঠানো হলো হাজতে। যা হোক, এই ঘটনার পর নতুন দরদী উকিল নবীদুর রহমানের দ্বারস্থ হলেন আসামিদের আত্মীয় অনাত্মীয় দরদী স্থানীয় কিছু দেশপ্রেমিক মানবিক মানুষ। এঁদের মধ্যে কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক এম এ মামুন (পরবর্তীতে মসজিদ্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা), কাটিরহাট রেল স্টেশন মাস্টার নওয়াব মিয়া ( নোয়াজিশপুর, রাউজান), কোর্ট বাবু আবদুল মান্নান (বর্তমানে ফৌজদারি আদালতে সি এস আই নামে পরিচিত ) সহ অনেকের সহায়তায় কয়েকবছর পর, এই মামলার আসামিরা খালাস পান। ফৌজদারি মামলার নিয়মানুযায়ী টি এ প্যারেড অর্থাৎ আসামি শনাক্তকরণ মহড়া করা হয় লালদিঘি মাঠে। প্রথম বার হাজতি আসামিদের সাথে একত্রিত করে শনাক্তকরণ মহড়া আয়োজিত হলে, আসামি পক্ষে প্রতিবাদ করে বলা হয় যে, ছাত্র আর কয়েদী সহজেই পৃথক করা যায়।
তাই, সাধারণ ছাত্রদের মধ্য থেকেই আসামি ছাত্রদের শনাক্ত করতে হবে, এমন আবেদন করা হলে তা মঞ্জুর করা হয়। শেষমেষ, চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রদের মধ্যে এই আসামি ছাত্রদের মিশিয়ে দিয়ে শনাক্তকরণ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। শনাক্তকরণে নিয়োজিত রেলের কর্মচারীরা সেদিন চিনেও না চেনার ভান করে মামলা থেকে আসামিদের খালাস পেতে সহায়তা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের এই আসামিদের পক্ষে দাঁড়ানো সবাই ভাষা সৈনিকের মর্যাদা পাবার উপযুক্ত। তাঁদের সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কাটিরহাটের পার্শ্ববর্তী বংশাল এলাকার বাহার উল্লাহ্ চৌধুরী নামের একজনও নাকি ভাষা সৈনিক ছিলেন। ছিলেন আরো অনেকে, যাঁরা সেদিন মিছিলে এবং রেলপথ অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে, ভাষা সৈনিক আলম খাঁন আসামি হিসেবে এই চারজনের কথাই আমাকে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক আমার আব্বা সৈয়দ আবদুল মাবুদের পক্ষে ইস্যুকৃত মেট্রিক সার্টিফিকেটে দেখা যায়, আব্বা মেট্রিক পাশ করেন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। অথচ, ১৯৫২ তে, তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে ১৯৫৪ তে পাস করার কথা। এক বছর ব্র্যাক অব স্ট্যাডি হয়ে গেল মামলা মোকদ্দমার পরিণামে হয়তো। না হয়, আমার আব্বার ছোট ভাই চাচা সৈয়দ আবদুল মান্নান, আব্বার আগেই মেট্রিক পাশ করেছিলেন। আল্লাহ পাক, আমার মরহুম আব্বাসহ সকল ভাষা সৈনিকদের মাফ করে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এবং ভাষা সৈনিক
সৈয়দ আবদুল মাবুদের বড় ছেলে।