আমাদের সংসদ নির্বাচন ২০২৩ ভোটারদের দরজা-জানালা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। জীবনে শেষ প্রান্তে তথা আট দশকের একজন ভোটার হিসেবে ব্যালট বা ইভিএমে ভোট প্রয়োগে জাতির সাথে অপেক্ষায় আছি।
বৃটিশ ভারতে ১৯৩৫ ও ১৯৪৬, পাকিস্তানে ১৯৫৪, ১৯৬২ ও ১৯৬৫, এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১৭টি প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, পৃথক ও সম্মিলিত পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৩৫, ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ এর নির্বাচনত্রয় মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য পৃথকভাবে নির্ধারিত আসনে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৬২ হতে অদ্যাবধি যৌথ পদ্ধতিতে হয়ে আসছে।
১৯৩৭ ও ৪৬’র নির্বাচন বৃটিশ সরকারের অধীনে; ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ এর নির্বাচন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ; ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৭৯ ও ১৯৮৬’র নির্বাচন সামরিক শাসনামলে; ১৯৭৩, ২০১৪ ও ২০১৮’র নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শাসনকালে; ১৯৮৮’র নির্বাচন জাতীয় পার্টি শাসনকালে; ১৯৯৬’র মার্চের নির্বাচন বিএনপি ক্ষমতাসীন আমলে; ১৯৯১’র নির্বাচন অন্তবর্তী সরকার এবং ১৯৯৬ জুন, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ ও ১৯৬৫’র নির্বাচনদ্বয় যথাক্রমে ৮০ হাজার ও ১ লাখ ২০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীদের পরোক্ষ ভোটে হলেও বাকী ১৫টি কিন্তু প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৬ ও ১৯৭০ নির্বাচন দুটি অনুষ্ঠিত হয় বৃটিশ শাসন ও পাকিস্তান শাসনমুক্তি এবং ১৯৫৪ ও ১৯৯১’র স্বৈরশাসক যথাক্রমে মোহাম্মদ আলী বগুড়া-নুরুল আমিন নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ও লে: জেনারেল হোসেন মুহাম্মদ এরশাদের একনায়কতন্ত্রবাদ শাসনের অবসানের দাবীতে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশেম ও মওলানা আতাহার আলী’র যৌথ নেতৃত্বাধীন ২১ দফা দাবী ভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট এবং জননেত্রী শেখ হাসনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সাথে স্বাধীনতা পক্ষীয় কয়েকটি দল ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ডানপন্থী দল নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। এতে ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩ ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি এবং ৯১-তে বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৯১, জাপা ৩৫, জামায়াত ১৮টি আসন পায়।
’৪৬-র নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (২ এপ্রিল ৩৭-১ ডিসেম্বর ’৪১) ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি (১৯৩৮-৪১) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ’৪০-র ২৩ মার্চ লাহোরের মিন্টু পার্কে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অধিবেশনে ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির স্বাধীনতার দাবীর প্রেক্ষিতে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী (২১ এপ্রিল ’৪৬-১৩ আগস্ট ’৪৭) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪২-৪৭) বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ইতিহাসে অন্ধ রাজনীতিবিদ খ্যাত আবুল হাশিমের যৌথ নেতৃত্বে বঙ্গীয় আইন পরিষদে ১২১টি নির্ধারিত মুসলিম আসনে মুসলিম লীগ ১১৮টি আসনে নিরংকুশ বিজয় লাভ করে। পক্ষান্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাঁরই ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবীর সমর্থনে পূর্বাঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬২ আসনে আওয়ামী লীগ ১৬০টিতে নিরংকুশ বিজয়ী করে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকে রাবার স্ট্যাম্প দিলেও ত্রিশ লক্ষ শহীদকে এর মুল্য দিতে হয়।
’৭০-র নির্বাচনে শহর এলাকায় ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদে নৌকার প্রার্থী চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯৪৯-৭১) ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম দৃঢ়চেতা সংগঠক এম.এ. আজিজ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি (১৯৬৩-৭২) জহর আহমদ চৌধুরীর (মন্ত্রী ২৫ জানু, ১৯৭২- ১ জুন ১৯৭৪ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ১৯৫৪-৫৮ ও ১৯৭০-৭১, বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য এপ্রিল-ডিসেম্বর ৭২ সংসদ সদস্য ৭ মার্চ ১৯৭৩-১ জুন ১৯৭৪) পোলিং এজেন্ট হিসাবে দেওয়ান বাজার ওয়ার্ড কার্যালয়স্থ (সিরাজদ্দৌল্লা সড়ক) ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করি এবং ১৯৭৩’র ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম সাধারণ নির্বাচন তথা প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই কেন্দ্রে মরহুম জহর আহমদ চৌধুরীর পোলিং এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭৩ সালে ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল ঈদ উৎসব। যদিও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জাসদ, ন্যাপসহ বহু দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এতে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯২টিতে বিজয়ী হয়। তৎমধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সহ ১১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ দলীয় মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৬-৫৭/৫৭-৫৮) আতাউর রহমান খান জাতীয় লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন ও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান (৭ এপ্রিল ’৭৩ – ২৫ জানু ’২৫)।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠে আসে তেমনি নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল নিয়েও কথা উঠে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ১৯৭৯-র ১৮ ফেব্রুয়ারিতে যা সামরিক আইন প্রশাসক (২৯ নভেম্বর, ৭৬-২১ এপ্রিল ’৭৯) লে: জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউর রহমানের আমলে সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি কাকতালীয়ভাবে জাতির ও মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক দর্শনের সাথে সম্পূর্ণভাবে প্রহসন ছিল। এতে স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগ ১২, জামায়াত ৬ জন নির্বাচিত হয়। এমনকি সামরিক-বেসামরিক ও নির্বাচন কমিশনের সহায়তা নির্বাচন করা হয়। এতে বিএনপির নির্বাচিত ২২০ জনের মধ্যে প্রায় ১৫০ জন স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিরোধী ছিল (শাহ আজিজ, খান এ সবুর, মশিয়র রহমান যাদু মিয়া, আবদুল আলীম, কাজী কাদের, ব্যারিষ্টার আবদুল হক, কর্ণেল মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীর মুহাম্মদ আদেল, আবদুল মোমেন খান, এএসএম সোলায়মান। (মন্ত্রী ডা. মালেক মন্ত্রীসভা ‘সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ’৭১), মওলানা আবদুল মান্নান প্রমুখ)। নির্বাচনে বিএনপি ২২০, আওয়ামী লীগ ৪০ জন নির্বাচিত হয়। মুসলিম লীগের খান এ সবুর ৩টি ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ২টিতে নির্বাচিত হয়। একইভাবে ৮৬’র ৭মে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনটি সামরিক শাসনের অধীনের প্রহসনমূলক আরেকটি নির্বাচন। জাতীয় পার্টি ১৮৩, আওয়ামী লীগ ৭৬ ও জামায়াত ১০টি পায়।
আবার তত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নির্বাচন নিয়ে একই প্রশ্ন রয়ে গেছে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারিত লতিফুর রহমানের ভূমিকা এবং পরবর্তীতে তার প্রকাশিত বইতেও তিনি সুস্পষ্টভাবে পক্ষপাতিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এতে বিএনপি ১৯৩, আওয়ামী লীগ ৬২, জামাত ১৭ ও জাপা ১৪টি আসন পায়।
ইতিহাসের আলোকে স্বীকার করতে হবে যে, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনের ৯১’র ২৭ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই নির্বাচনে আমি একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রধান এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। নির্বাচনে বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৯০, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি ৩৫ ও জামাত ১৮ আসনে বিজয়ী হয়।
৯৬-র ১১ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পূর্বে সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ নাসিম বীরবিক্রম ক্ষমতা দখলের এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস (৯ অক্টোবর ’৯ অক্টোবর ৯৬) ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের (৩০ মার্চ-২১ জন ’৯৬) দৃঢ়চেতা মনোভাবের সাথে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মোকাবেলা করেন। এতে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬ ও জাপা ৩২টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনেও আমি একটি আসনে প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলাম। এসময় প্রতিপক্ষের হামলা আমাদের গাড়ী উল্টে গেলে আমার বুক ও পিটের মোট ৭টি হাঁড় ভেঙ্গে যায়। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ ১৯৮৮ ও ১৯৯৬’র ফেব্রুয়ারি এবং বিএনপি ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০১৪ সাল নির্বাচন বয়কট করে। ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে বিরোধী দল হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি, তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে জামাত, মুসলিম লীগ সহ ছোট ছোট ডানপন্থী দলগুলি অংশগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তারা মাঠে নেই- জনগণের কাছে নেই। তারা মাঝে মধ্যে আন্দোলনের ডাক দেয় – কিন্তু চরমভাবে ব্যর্থ।
মাঝে-মধ্যে বিএনপি’র নেতৃত্ব আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের কথা ঘোষণা করে। প্রশ্ন হল আন্দোলন কাকে বলে, কি ধরনের বা কে নেতৃত্ব দেবে? আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে আপোষহীন নেতৃত্বেকে সর্বক্ষণ মাঠে থাকতে হবে-রাজপথে চলতে হবে। সবচেয়ে সুস্পষ্ট কথা হল আন্দোলন মানে ড্রইংরুমে বসে কথা বলা, প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা, সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়া নয়। ছাত্র-শ্রমিককে মৌলিক বিষয় ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু বিরোধী দল তা পারবে না। সন্ত্রাস করে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নির্বাচনে ভোট আসবে না। স্বীয়-চরিত্র ও মনোবলকে সুদৃঢ় করতে হবে, জনতাকে গ্রহণযোগ্য ইস্যু দিতে হবে।
আমেরিকা, বৃটেন, ভারত, পাকিস্তান সহ বহু দেশের কোনটিতে ব্যালট আবার কোনটিতে ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও কারচুপি হয়। সংবাদ মাধ্যমগুলিতে সংবাদ পাওয়া যায়। অতএব ব্যালট হোক আর ইভিএম পদ্ধতিতে হোক, কারচুপি অভিযোগ থাকবেই।
ভোট কেন্দ্র সীমিত হওয়ায় ভোটারদের অনেকে ভোট দিতে পারে না। তাই একটি ভোট কেন্দ্রকে চারটি বা ততোধিক কেন্দ্র করা হলে ভোট গ্রহণ দ্রুতলয়ে চলবে এবং ব্যালট গণনায়ও সহজ হবে। তবে এজন্য রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তখন চরদখলের মতে ভোট কেন্দ্র দখলে ও কষ্টকর হবে।
লেখক : জীবন সদস্য-বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২-৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিষ্ট।