বিশ্বকাপে টানা ১০ ম্যাচে জয়। এক প্রকার আকাশেই উড়ছিল ভারত। দেশের মাটিতে আরও একবার বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখছিল ভারতের ১৪০ কোটি মানুষ। কিন্তু শেষবেলায় তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার ১১ ক্রিকেটার। ফাইনালে ব্যাটে–বলে পর্যুদস্ত ভারতকে মাটিতে নামিয়ে আনল অস্ট্রেলিয়া। ভারতজুড়ে উৎসবের আবহকে ম্লান করে ফাইনালের মহামঞ্চে উড়ল তাদের বিজয় কেতন। ৭ উইকেটের জয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল জিতে নিল তাদের ষষ্ঠ শিরোপা। সেই অস্ট্রেলিয়া, বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর যাদেরকে মনে হয়েছিল ছন্নছাড়া। সেই দলটিই টানা ৯ জয়ে এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
ভারতকে নীল বেদনায় ডুবিয়ে হলুদের উৎসব হলো আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এক লক্ষ ত্রিশ হাজার দর্শক। ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও। ম্যাচের আগের দিন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত করেই দর্শক থাকবে একপাক্ষিক। কিন্তু খেলায় এমন বিপুলসংখ্যক সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়া হবে তৃপ্তিদায়ক। আমাদের লক্ষ্য এটাই।’ হলোও তা–ই। একসঙ্গে এত মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেমন হয়, নীরবতার ভাষা কেমন, আর হাহাকারের শব্দ, সবকিছুরই সাক্ষী হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। বরাবরের মত এবারে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল ফেভারিটের তকমা গায়ে লাগিয়ে। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারের পর চারদিকে যেন গেল গেল রব। শেষ চারে যেতে পারবে কিনা সে শংকাই করছিলেন অনেকে। কিন্তু দুই ম্যাচে হারের পর যেন ঘুম ভাঙল তাদের। সেই যে ঘুরে দাড়াল আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। অপরদিকে হারের আঁচড় দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো পরীক্ষায়ও ফেলতে পারেনি আগের টানা ১০ ম্যাচে। ফাইনালের জন্য যে দলটি ছিল নিরঙ্কুশ ফেভারিট, সে দলটিই কিনা আসল লড়াইয়ে একেবারে অসহায় আত্মসমর্পন করল। কপিল দেবের পর ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন ধোনি–টেন্ডুলকাররা। কিন্তু ধোনি–টেন্ডুলকারের একযুগ পর রোহিত–কোহলিদের সামনে এসেছিল আরেকটি বিশ্বকাপ ভারতকে উপহার দেওয়ার সুযোগ। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি ভারত। ফলে তাদের পক্ষে ২০ বছর আগের বদলা নেয়া হলো না। ১২ বছর পর বিশ্বকাপ জয় হলো না। ১০ বছর ধরে আইসিসি ট্রফি না পাওয়ার খরাও কাটল না। কপিল দেব, মহেন্দ্র সিং ধোনির পাশে দাড়াতে পারলেন না রোহিত শর্মা। তবে এলান বোডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংদের পাশে নিজেকে বসিয়ে দিলেন প্যাট কামিন্স। ১৩ আসরে ৮ বার ফাইনাল খেলে ট্রফি নিয়ে গেল ৬ বার।
দিনের আলোয় নরেন্দ মোদি স্টেডিয়ামকে আলোকিত করেছিল গ্যালারির নীল ঢেউ। আর রাতের বেলায় আতশবাজির আলোয় উদ্ভাসিত পুরো আহমেদাবাদের আকাশ। কিন্তু এসব যেন ভারতের ক্রিকেটারদের কাছে গাঢ় অন্ধকারের মত। ম্যাচ শেষ হতেই রোহিত–কোহলিরা মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়লেও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা আনন্দে ভাসছিল। টসে জিতে স্বাগতিক ভারতকে ব্যাটিয়ের আমন্ত্রণ জানায় অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। আর আগে ব্যাটিং পেয়ে ভারতের শুরু যথারীতি আগের দশ ম্যাচের মত উড়ন্ত। শুভমান গিলকে দর্শক বানিয়ে অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের উপর চড়াও হন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তাই শুরুতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল প্যাট কামিন্সের সিদ্ধান্ত। তবে পাল্টা আক্রমণ করতে বেশি সময় নেয়নি অস্ট্রেলিয়া। ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই প্রথম ধাক্কাটা খায় ভারত। শুরুর দিকে একবার জীবন পেলেও মিচেল স্টার্কের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ব্যাটের ঠিক জায়গায় লাগাতে পারেননি শুভমান গিল। ৭ বলে ৪ রান করে ফিরেন সাজঘরে। তার বিদায়ের পরও রোহিত শর্মা রানের গতি রেখেছিলেন সচল। পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে ভারত তুলে নেয় ৮০ রান। কিন্তু এর মধ্যে তাদের হারাতে হয় রোহিত শর্মার উইকেটও। ৪ টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৩১ বলে ৪৭ রান করে ফিরেন ভারত অধিনায়ক। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা শ্রেয়াশ আইয়ার পারেননি চাপে পড়া দলকে টানতে। মাত্র ৩ বলে ৪ রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন আইয়ার। শ্রেয়াসের বিদায়ের পর রাহুলকে নিয়ে ধীরে ধীরে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন বিরাট কোহলি। দলের পুরো ভরসা যখন কোহলির উপর তখন তিনি পারলেন না ফাইনালে নিজের ইনিংসটাকে বড় করতে। অসি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের শর্ট বল কাট করতে গিয়ে কোহলির ব্যাটে লেগে স্টাম্পে যায়। বোল্ড হয়ে ফিরেন এবারের বিশ্বকাপতো বটেই যেকোনো বিশ্বকাপের সবচাইতে বেশি রান করে রেকর্ড গড়া কোহলি। ৬৩ বলে ৪টি চারের সাহায্যে ৫৪ রান করে ফিরেন বিরাট। আর এর ফলে এবারের বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচে ৯৫.৬২ গড় ও ৯০.৩১ স্ট্রাইক রেটে ৭৬৫ রান করেছেন কোহলি। রোহিত শর্মা ৫৯৫ রান করে আছেন দুইয়ে।
কোহলির সঙ্গে ৬৭ রানের জুটি ভাঙার পরও রাহুল ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মিচেল স্টার্কের দুর্দান্ত এক বলে আর টিকতে পারেননি তিনি। ১০৭ বল খেলে রাহুল করেন ৬৬ রান। তার বিদায়ের পর সব আশাই ছিল সূর্যকুমার যাদবকে ঘিরে। কিন্তু তাকেও স্লো বল করে বিপাকে ফেলে দেয় অস্ট্রেলিয়া। আলো না ছড়িয়েই সাজঘরে ফিরেন সূর্য। ২৮ বলে ১৮ রান করে হ্যাজেলউডের শিকার হন তিনি। এরপর শেষ উইকেট জুটিতে যোগ হয় আরও ১৪ রান। ১৮ বলে ১০ রান করে ইনিংসের শেষ বলে রান আউট হন কুলদিপ যাদব। ৯ রানে অপরাজিত থাকেন মোহাম্মদ সিরাজ। আর তাতে ভারতের ইনিংস থামে ২৪০ রানে। যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল ভারতের জন্য। বল হাতে অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক ৩টি এবং হ্যাজেলউড ও প্যাট কামিন্স ২টি করে উইকেট নিয়েছেন।
২৪১ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা বেশ ঝড়ের বেগে করেছিল অস্ট্রেলিয়াও। জাসপ্রিত বুমরাহর করা প্রথম ওভারেই ১৬ রান তুলে নেন ট্রেভিস হেড এবং ডেভিড ওয়ার্নার। কিন্তু পরের ওভারে বল করতে এসেই ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ধাক্কাটা দেন মোহাম্মদ শামি। এবারের বিশ্বকাপে বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন ভারতের এই পেসার। সে ধাক্কা না সমালাতেই জাসপ্রিত বুমরাহর আঘাত। তার শিকার মিচেল মার্শ। দলের ৪১ রানের মাথায় বুমরাহর একটু লাফিয়ে ওঠা বলে কাট করতে চেয়েছিলেন মার্শ। কিন্তু বল ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় উইকেটের পেছনে রাহুলের হাতে। ১৫ বলে ১৫ রান করে ফিরেন মার্শ। নিজের পরের ওভারে আবার বুমরাহর আঘাত। এবার তার শিকার স্টিভেন স্মিথ। এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে ফিরেন এই মিডল অর্ডার ৪ রান করে। ৪৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে তখন কাঁপছিল অস্ট্রেলিয়া। গ্যালারির ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শকের গগণবিদারি আওয়াজে যেন পা কাঁপছিল অসি ব্যাটারদের। তবে সে সব উপেক্ষা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ট্রেভিস হেড এবং মারনুস লাবুসাঙ্গে। কে জানতো এ দুজন ম্যাচটাকে শেষ করে দিয়ে আসবে। সেমিফাইনালে ৪৮ বলে ৬২ রানের ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে নিয়ে আসতে বড় ভূমিকা রাখা হেড গড়লেন ১৯২ রানের জুটি। যেখানে তাকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন লাবুসাঙ্গে। দল যখন বিশ্বকাপ হাতে নেওয়া থেকে মাত্র দু রান দূরে তখন ফিরেন হেড। তবে ফেরার আগে ১২০ বলে ১৫টি চার এবং ৪টি ছক্কার সাহায্যে ১৩৭ রানের বিশ্বজয়ী ইনিংস খেলে আসেন। যা তার ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। আর এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয়। মেক্সওয়েল দুই রান নেওয়ার সাথে সাথে মাঠে উল্লাসে ফেটে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। কারণ আরেকটি বিশ্বকাপ যে এখন তাদের শোকেসে।
ফল : অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে জয়ী। ম্যান অব দা ম্যাচ : ট্রাভিস হেড। ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট : বিরাট কোহলি।