অনিয়ম আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা
আমার প্রাণের নগরী চট্টগ্রাম
বছর দুয়েক আগেও দেশে এসে পৌঁছার পর কখন আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার নগরী চট্টগ্রাম যাবো সে জন্যে হা-হুতাশ করতাম। ঢাকার যানজট ছিল অসহনীয়। আর সে কারণে কয়েকটি অভিজাত এলাকা ছাড়া ঢাকা ভালো লাগতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঢাকার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চাটগাঁ! উন্নতির লক্ষণ খুব একটা চোখে পড়ে না। উল্টো অবস্থার অবনতি হয়েছে বহুগুণ। দিন দশেক আগে দেশে এসে পরদিনই চাটগাঁ গিয়েছিলাম। মনে হলো আমার প্রাণের শহর চাটগাঁ হারিয়ে ফেলেছে তার কমনীয়তা। মনে হলো ‘জঞ্জাল’ আর অনিয়মের শহরে এলাম। যে শহরে নিঃস্বাস নিয়ে বড় হয়েছি, সে শহর হারিয়ে গেছে। চারিদিকে অনিয়ম, অব্যবস্থা, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবন, রাস্তা, ফুটপাত, ফুটপাতের উপর গড়ে উঠা দোকান ইত্যাদি। রাস্তার পাশে আবর্জনা, নালা খালের অনেকটা স্থান দখল করে গড়ে উঠা বাড়িঘর, দোকানপাট। কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে। শহরের প্রতিটি এলাকায় বসতবাড়ি, স্কুল, হাসপাতালের সামনে রিক্সা সিএনজি স্ট্যান্ড, উন্মুক্ত বাজার, ফুটপাত ছাড়িয়ে গাড়ি-রাস্তা দখল করে সারিবদ্ধ ফেরিওয়ালা। সকাল থেকে অনেক রাত অব্দি চলে সেখানে ভিড়, হৈহুল্লোড়, চেঁচামেচি। মূল সড়ক ছাড়িয়ে ভেতরের রাস্তার মধ্যে ব্যাটারি চালিত রিক্সাগুলির বেপরোয়া আচরণ। আমার পার্মানেন্ট চালক বলে, ‘স্যার, আমরা সবাই স্বাধীন, তাই যা ইচ্ছা তাই করি’। যেন বলার কেউ নেই, ধরার কেউ নেই। নেই কারো কোন দায়বদ্ধতা, কারো কাছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট-বিহীন বাসগুলির রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে প্যাসেঞ্জার উঠানামা-এ নিত্য দৃশ্য। জিইসি মোড়, চকবাজার, নিউ মার্কেট, আগ্রাবাদ, এমন কী স্কুল সময়ে জামালখান এলাকা- সব জায়গায় একই চিত্র। বছরের পর বছর এ চিত্র দেখে আসছি। ভালোর দিকে কোন পরিবর্তন দেখিনা। কোথায়ও কোথায়ও ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট, কনস্টেবল চোখে পড়ে। কিন্তু তারা প্রায় সময়, প্রায় ক্ষেত্রে দর্শক হয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। আবার তাদের অনেকেই দেখি চলমান প্রাইভেট কার, ট্রাক, মাইক্রোকে হাতের ইশারায় রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে ‘উপরি’ হাতিয়ে নেয়ায় ব্যস্ত। দিন দুয়েক আগে যে বাহনটি আমাকে ‘বহন’ করে আমার গন্তব্যস্থলের দিকে এগুচ্ছিল, এক সময় হাতের ইশারায় তাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করালো। প্রথমে এলো ট্রাফিক কনেস্টেবল, তারপর সার্জেন্ট। এলাকা গোলপাহাড়। ড্রাইভার নেমে তাদের সাথে কী কথাবার্তা বললো, গাড়ি থেকে বের করে তাদের কাগজপত্র দেখালো। ক্ষণিকবাদে বিরক্তি নিয়ে ড্রাইভার ফিরে এসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘স্যার, আমার গাড়ির সব ডকুমেন্ট আছে। তারপরও এটা-ওটা চাইছে। মূল কথা টাকা দাও।’ গাড়ি এগিয়ে চলে শিল্পকলা একাডেমির দিকে। বিকেল পাঁচটায় সেখানে সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে অনেক বক্তার আমি একজন। আলমাস সিনেমা হল পেরিয়ে কদ্দুর এগোতেই আবারো এক ট্রাফিক কনস্টেবল হাতের ইশারায় গাড়ি দাঁড় করাতে বললো। মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে এই খপ্পরে পড়েছি। এবার মেজাজ গেল বিগড়ে। ড্রাইভারকে বললাম, ‘তোমার নামার দরকার নাই, সামনের জানালা নামাও, আমি কথা বলবো। চড়া মেজাজে বললাম, ‘সমস্যা কী? আমার পাঁচটায় মিটিং আছে।’ আমার চোখ-মুখের বিরক্তি দেখে সে কী বুঝলো কে জানে, দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে অপরাধের সুরে বলে, যান, যান। আমার চালক বলে, ‘স্যার, কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকা গিয়েছিলাম প্যাসেঞ্জার নিয়ে। আমার গাড়ি দাঁড় করালো এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। সব ঠিক আছে, তারপরও বলে, এক হাজার টাকা দাও, নইলে ‘কেইস’ অর্থাৎ মামলা ঠুকে দেব। অনেক অনুরোধ করি তাকে, বলি, এই গাড়ি চালিয়ে আমি সংসার চালাই, আমি গরিব মানুষ। পাঁচশ টাকা দেই। কিন্তু সার্জেন্টের মন গলে না। উল্টো বলে, ‘অত কথা নয়, বিশ লক্ষ টাকা দিয়ে এই চাকরিতে আসছি। টাকা দাও। নইলে কেইস খাবা’।
মূল কথা সব দিকে দৈন্য দশা। দিন কয়েক আগে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘ধরা’ নামের একটি সংগঠন। পুরো নাম ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’। দেশে এলে নানা কাজে-অকাজে ব্যস্ত থাকি। কোনভাবেই এড়াতে পারিনি এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক ‘নওজোয়ানের’ (এনজিও) পরিচালক ইমাম হোসেনের অনুরোধ, যদিও বা আলোচনার বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ‘চট্টগ্রাম বিভাগের পরিবেশ সংরক্ষণে করণীয়’। চমৎকার ছিল এই আয়োজন, আমন্ত্রিত বক্তাদের মূল কথা : সমস্যার আবর্তে চট্টগ্রাম সহ গোটা দেশ। চট্টগ্রাম নগরীর সমস্যার পেছনে মূল যে কারণ, তা অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সালাউদ্দীন রেজার ভাষায়, ‘সিডিএ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাগুলির সমন্বয়হীনতা ও তদারকির অভাব’। তিনি বলেন, ‘সিডিএ যে প্ল্যান দেয় তা প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরিকল্পিত, অন্যদিকে ‘২০০৮ ভবন নির্মাণ নীতিমালা’ যেটি রয়েছে তা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মানা হয়না। এই নীতিমালা অনুয়ারি ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে সিডিএ-র নজরদারি থাকবে। নির্মিত হবে প্ল্যান অনুযায়ি। কিন্তু মোঃ সালাহউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, বাস্তবে তেমনটি হয়না। সিডিএ অজুহাত দেখিয়ে বলেন, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, অথচ দেখা যায়, যারা আছেন, যারা এই সমস্ত অনিয়ম দেখার কথা তারা টাকা খেয়ে অবৈধ নির্মাণকে উৎসাহিত করেন।’
এই নগরীর আর এক দুঃখ হলো জলাবদ্ধতা, নগরীর পুরানো নয়, প্রাচীন সমস্যা। সে আমার বুদ্ধি বয়স থেকে দেখে আসছি, শুনে আসছি। এই সমস্যা সমাধানে প্রকল্প পাশ হয়, অর্থায়ন হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে কাজও শুরু হয়। কিন্তু যা হয়না তা হলো পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন। ড্রেনের পাশে বিল্ডিং, নালা খাল দখল করে, ঢেকে দিয়ে তার ওপর ভবন নির্মাণ যুগের পর যুগ দেখে আসছি। কোন কোন স্থানে ইদানীং কিছু অবৈধভাবে নির্মিত ভবন, দোকান ভাঙা হয়েছে, সেটি ভালো লক্ষণ। প্রেস ক্লাব প্রেসিডেন্ট এই প্রসঙ্গে অভিযোগ করে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি কেবল একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে খালাস। কাজের বেলায় কোন পরিবর্তন ঘটেনা।’ সুখের বিষয় দিন কয়েক আগে দৈনিক আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠায় এক সংবাদে দেখলাম, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের কাজ ৬৫% শতাংশ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি আগামী বর্ষাকে সামনে রেখে ৩১ মার্চের আগে প্রকল্পের আওতায় খালে চলমান রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ-কাজের সব উপকরণ সরিয়ে ফেলা হবে। এরপর বর্ষার আগে খালগুলি খনন ও পরিষ্কার করা হবে। এই তথ্য দেন মেগা প্রকল্পের সেনাবাহিনীর পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ ফেরদৌস। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেহেতু এই প্রকল্পে জড়িত তখন প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বলে দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেন এক নগরবাসী। উক্ত অনুষ্ঠানে সমাজকর্মী এম এ সবুর তার উত্থাপিত প্রবন্ধে বলেন, চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানির সমস্যার কারণে অনেক সময় বাইরে থেকে পানি কিনে ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ সারেন অনেকে। ‘ইচ্ছে করে ওয়াসা পানির চাপ এলাকায় কমিয়ে রাখে’ বলে অনেকের অভিযোগের কথা উল্লেখ করেন তিনি তার প্রবন্ধে। পানির চাপ কম থাকলে দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অভিযোগের শেষ নেই। অভিযোগ, পানির কারণে বড় সমস্যার সম্মুখীন হন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ময়লা পানি পান করার কারণে অনেক সময় ছোট ছোট শিশুদের অসুখ লেগেই থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। তবে পাশাপাশি বাসার লাইনের ট্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ট্যাঙ্কও অনেক বাড়িওয়ালা সময়মত বা ঠিকভাবে পরিষ্কার করেননা বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর চাইতে ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেন আর এক বক্তা। তিনি (খুব সম্ভত স্যার মরিস ব্রাউন স্কুলের শিক্ষক নাজমা ইয়াসমিন) ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের’ এক তথ্যের উল্লেখ করে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে যে হারে বায়ু দূষণ হচ্ছে, তাতে চট্টগ্রামবাসীর গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৬.৬ বছর। বায়ুতে বিষাক্ত তার পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে থাকলে চট্টগ্রাম মহানগরের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭ বছর বেশি হতো। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী বাতাস বিষাক্ত হচ্ছে। অনুন্নত দেশে পানি পান করা যায়না বটে, তবে উন্নত দেশেও মুক্তভাবে নিঃস্বাস নেয়া দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রকৃতির মূল শত্রু মানুষ। মানুষের মধ্যে ভূমি দস্যু, মানুষের মধ্যে বন খেঁকো, মানুষের মধ্যে ব্যাংক লুটেরা, মানুষের মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ী। মানুষ বিশেষ করে অর্থ-বিত্তশালীদের বৃহৎ একটি অংশ হচ্ছে অসৎ। গেল সপ্তাহে পত্রিকায় দেখলাম, ‘গাছের জন্য শোকসভা’। গাছ কেটে চলেছে নির্বিচারে। এই সমস্ত প্রকৃতি-বিরোধী লোভী শ্রেণি কেবল তার নিজের আর্থিক লাভ-লোভের কথা ভাবছে। সে ভাবছে না তার রেখে যাওয়া পরবর্তী প্রজন্মের কথা, এমন কী তার নিজ সন্তানদের, পরবর্তী বংশধরদের কথা। সার্কিট হাউজের সামনের জায়গাটা আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছিল চট্টগ্রামের অন্যতম একটি আকর্ষণী স্থান, সেটি লিজ দেয়া হয় সিটি কর্পোরেশনকে। সেখানে প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে গড়ে তোলা হয় শিশু পার্ক। দীর্ঘ ২৫ বছর পর লিজ বাতিল হলেও সমপ্রতি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলির অনেকগুলি কাটা হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ এবং বাকিগুলিও কাটা হবে জানা গেছে। সেখানে এখনো রয়েছে ১২১টির বেশি গাছ। বিপ্লব উদ্যান ও এম ই এস কলেজের পাশে কবরস্থানের সব গাছ ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ অপকর্ম করছে যদ্দুর জানি সিটি কর্পোরেশন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘A nation that destroys its soils destroys itself. Forests are the lungs of our land, purifying the air and giving fresh strength to our people ’ অর্থাৎ যে জাতি তার মাটি ধ্বংস করে সে নিজেকে ধ্বংস করে। বন হলো আমাদের ভূমির ফুসফুস, যা বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং আমাদের জনগণকে দেয় নব শক্তি। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট