শারীরিক সুস্থতা, আত্মিক উন্নতি ও স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনে রোজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

ড. আবদুল আজিম শাহ্‌ | শনিবার , ১৬ মার্চ, ২০২৪ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে সিয়াম বা রোজা অন্যতম। আরবি সাওম হতে ‘সিয়াম’ শব্দের উৎপত্তি। ফার্সি ভাষায় বলা হয়- রোজা, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, সংযম করা। এই উপমহাদেশে রোজা শব্দের সাথেই সকলেই অধিক পরিচিত। রোজা শব্দের আরেকটু বিশদ অর্থ হলো আত্মসংযম, নফসের বিদগ্ধকরণ সহ কঠোর সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন। রোজার সংজ্ঞা দাঁড়ায়-প্রতিজ্ঞা সহকারে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৈহিক কামাচার, নেতিবাচক কর্ম সহ যাবতীয় পানাহার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার নাম রোজা। প্রাপ্তবয়স্ক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর রোজা পালন অত্যাবশ্যক। এই সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন শরিফে ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত- ১৮৩)। এটি এমন একটি ইবাদত যা দ্বারা আত্মশুদ্ধি করে সহজে আত্মোন্নয়ন ঘটানো যায়। রোজার সাথে তাকওয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুফিদের সম্রাট নামে পরিচিত (যাকে পশ্চিমা বিশ্ব Doctor of maxima বলে) হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (র.) আত্মশুদ্ধির চারটি প্রধান উপায়ের কথা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে অন্যতম একটি হলো রোজা বা ক্ষুধা। রোজা মানবের আত্মিক উন্নতির পথকে সুগম করে, কলুষিত আত্মাকে পবিত্র করে, মনকে শীতল করে, নিদ্রাকে তাড়ায়, অলসতা দূর করে, নেতিবাচক চিন্তা দূরীকরণ করে, চিন্তা শক্তিকে প্রসারিত করে, সর্বোপরি দৈবিক জ্ঞান লাভে সহায়তা সহ শ্রষ্টার নৈকট্যতা পেতে সাহায্য করে। রোজা অনুভূতি, উপলব্ধি ও চেতনাকে জাগ্রত করে, হৃদয়ে প্রশান্তি আনে, আত্মার উন্নয়ন ঘটিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। একই সাথে রোজা শারীরিক সুস্থতা আনয়ন এবং শরীরকে পরিশুদ্ধ করে। এর একটি বৈজ্ঞানিক কারণও আছে। (২০২০ সালের জানুয়ারিতে) লন্ডনে জেনারেল মেডিসিনের ওপর একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে- দৈনিক ১৬ ঘণ্টা উপোস (এর মধ্যে ৮ ঘণ্টা নিদ্রা) স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমরা যখন খাদ্য গ্রহণ করি তখন শরীরের নিজস্ব শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ অত্যধিক সক্রিয় থাকে। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হলো মানবদেহের শক্তির মূল আধার (Power House of the bodz)। খাদ্য গ্রহণের পর এটি সক্রিয় হয়ে এটিপি তে (ATP ) রূপান্তরিত হয়, যে শক্তি দ্বারা মানুষ দৈনন্দিন কর্ম পরিচালিত করে। কিন্তু সর্বক্ষণ খাদ্য গ্রহণের ফলে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি এন এ সর্বদা সক্রিয় থেকে দেহের বাহ্যিক শক্তি সরবরাহ করার জন্য অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে (মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ) নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পূর্ণ দেহ ও মস্তিষ্কের ওপর পড়ে। এতে মন মস্তিষ্ক সহ সম্পূর্ণ দেহ দুর্বল ও অলস হয়, নিদ্রালু ভাব আসে। ফলে চিন্তাশক্তি প্রসারে বাধা সৃষ্টি হয়। ইবাদতে খুব একটা মন বসে না। রোজা পালনে মাইটোকনন্ড্রিয়াল ডি এন এ শরীরের জন্য অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন করতে হয় না, তাই কিছুটা বিশ্রাম পায়। ডিএনএ দেহের অভ্যন্তরীণ শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে। এতে দেহের প্রতিটি মস্তিষ্কের ৯ ট্রিলিয়ন নিউরন, দেহের অগণিত কোষ সহ সমগ্র শরীর সক্রিয় হয়ে ওঠে। রক্ত সঞ্চালনের গতি বৃদ্ধি পায়। এর সু-প্রভাব মস্তিষ্কের ওপর পড়ে। মস্তিষ্ক অতিমাত্রায় সচল হয়ে ওঠে। এতে কর্মের গতি বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এর প্রভাব আত্মার ওপরও পড়ে। ধীরে ধীরে কলুষিত আত্মা পরিশুদ্ধ হতে থাকে। আত্মা উর্ধ্বমুখী হয়ে গ্রষ্টামুখী হয়। মস্তিষ্কে ইতিবাচক চিন্তার জাগরণ ঘটে। এতে মানুষের ভিতর লুকায়িত অন্তর্নিহিত যে আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে, তার জাগরণ ঘটে। এতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রাপ্তি সহজ হয়। কলুসিত আত্মা আলোকিত হয়। সর্বোপরি আত্মা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। রোজার মাধ্যমে যত সহজে আল্লাহকে পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো ইবাদত দ্বারা এত সহজে খুব একটা পাওয়া যায় না। এটি হলো রোজার বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। এছাড়া খনার বচনেও আছে -অধিক খেয়ে করে আশ, এর নাম বুদ্ধিনাশ। অর্থাৎ অতিরিক্ত আহারে বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটে। খনা আরো বলেছেন, ‘উনা ভাতে দুনা বল, অতিভাতে রসাতল’। অর্থাৎ অল্প আহারে দ্বিগুণ শক্তি, অধিক আহারে ধ্বংসের নিম্নস্তরে পতিত হয়। আরেক মহান সুফি আল কুশাইরী তাঁর ‘রিশালা’ গ্রন্থে বলেছেন, ইবনে আব্দুল্লাহর মতে- রোজা সুফি চর্চাকারী শিক্ষানবিশদের জন্য একটি নিয়মানুবর্তিতা, অনুশোচনাকারীদের জন্য একটি পরীক্ষা, সংযম সাধকদের জন্য একটি নীতি, দিব্যজ্ঞান (আরিফ বান্দা) প্রাপ্তদের জন্য একটি বিশেষ উপহার। অর্থাৎ সকল স্তরের ব্যক্তিদের জন্য রোজা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সকলের জন্য এটি উপকারী। সুফি হযরত ইবনুল আরবি (র.) রোজা পালন সম্পর্কে আরো বলেন, ‘রোজা (ক্ষুধা) দাসত্ব ও আত্মগৌরবের বিলোপ সাধন এবং নিম্ন চিন্তার দূরীকরণ করে’। অর্থাৎ তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জনের জন্য রোজা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। হযরত আবু হুরায়রা (র.) হতে বর্ণিত-রাসুল (দ.) কে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ বলেন,- ‘আসসাউমু লি ওয়া আনা উযজা বিহি” (হাদিসে কুদছি) অর্থাৎ- রোজা আমার জন্য এবং আমিই তাহার পুরস্কার। আরেকটু সহজ ভাবে বলা যায়- রোজার মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সহজে আল্লাহর দিদার লাভ করা যায়। অতএব আল্লাহভীতি, আত্মপবিত্রকরণ ও সন্তুষ্টি চিত্ততার নামই রোজা। অপরদিকে রোজা মানে নীরব থাকা, মনের পাপকে বিদগ্ধ করা। এ জন্য রাসুল বলেছেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ এবং তোমাদের কেউ রোজা পালন করা অবস্থায় যেন অশ্লীল বাক্য না বলে, কেউ যদি গালমন্দ করে অথবা ঝগড়ায় প্ররোচিত করে সে যেন বলে আমি রোজা পালনকারী (সহীহ বুখারী ১৮৯৪)। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যুদ্ধের সময় ঢাল যেমন আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত হয় তদ্রুপ রোজাও মানুষকে (নফস) প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা ও কলুষিত আত্মাকে পবিত্র করে এবং সকল প্রকার পাপাচার থেকে ঢালের মতো রক্ষা করে। এতে খাঁটি মানবে পরিণত হওয়া যায়। রোজার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও বরকতের বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত নূর নবীজি মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.) আরো বলেন, (আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত)- ‘রমজান মাসে তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করেছেন। এই মাসে আল্লাহর রহমতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়, জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এই মাসে এমন একটি রাত আছে যেটি হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি’ (সুনানে নাসায়ি ২১০৬)। রোজার ফজিলত এত বেশি যে- রমজান মাস ছাড়াও অন্যান্য মাসেও নফলরোজা রাখার নির্দেশনা ধর্মে রয়েছে, যাতে সহজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এইজন্য সুফি -সাধকগণকে সারা বছরই রোজা পালন করতে দেখা যায়।

রোজার দুটি অংশ পরিলক্ষিত হয় একটি আনুষ্ঠানিক অংশ, অপরটি হল নৈতিক অংশ। বর্তমানে অনেকেই রোজা রাখে, রোজার নামে উপবাস কিংবা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে কিন্তু রোজার মূল উদ্দেশ্য নৈতিকতা ধারণ করে না। অর্থাৎ উপবাস পালন করে কিন্তু সংযমী হয় না, তাকওয়ার চর্চা করে না, পাপাচার মুক্ত হয় না, আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করে না। নৈতিকতা বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রোজার গুরুত্ব তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন উপবাসের অন্তর্নিহিত কারণ তথা নৈতিকতাকে ধারণ করা হয়। রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে যদি আত্মার উন্নয়নসহ স্রষ্টার নিকট্য অর্জন করা না যায়; তাহলে সেই রোজা বৃথা। এতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন সহজ হবে না। তাইতো হাদীস শরীফে আছে, কতক রোজাদার আছে যাদের রোজাতে উপবাস ছাড়া আর কিছু হয় না, কতক রাত্রি জাগরণকারী আছে যাদের রাত্রি জাগরণে বিনিদ্রা ছাড়া আর কিছু অর্জন হয় না। (মাকালাতে কোরআনি, পৃষ্ঠা নম্বর ১৪০)। অতএব আনুষ্ঠানিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে যাতে রোজা পালন করা যায়, সেদিকে সকলের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরীফ, ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধফের জন্ম নেব আমি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে