অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার মত অনেকের কাছে ‘তারুণ্যের প্রতীক‘। তাকে দেখে, তার কথা শুনে আমরা উদ্দীপ্ত হই, অনুপ্রাণিত হই, স্বপ্ন দেখতে শিখি, নূতন করে বাঁচতে শিখি, ভালোবাসতে শিখি। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যদি ‘লেডী উইথ দ্য ল্যাম্প’ হন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হলেন ‘ম্যান উইথ দ্য লাইট অফ লার্নিং’, যিনি সারাটা জীবন জ্ঞানের–আলো ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন এবং বর্তমানে ৮৪ বছর বয়সে পৌঁছেও তিনি জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিচ্ছেন জনে জনে, ঘরে ঘরে। তাকে বলা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’। আমি বলি পাশাপাশি তিনি ভালোবাসা–সৃষ্টিরও কারিগর। তিনি তার কথায় মানুষের মনে ভালোবাসার জন্ম দেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতে শেখান। অনেক বিষয়ের মধ্যে এই ভালোবাসার শিক্ষাও তিনি দেন তার সৃষ্টি, ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে’। ঢাকার বুকে চমৎকার এই কেন্দ্রে বিশ্ব সাহিত্য, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ও প্রগতিশীল ধ্যান–ধারণার চর্চা চলে। সুদর্শন এই অধ্যাপক যখন কথা বলেন, যখন কথার মালা গাঁথেন তখন মনে হয় তার বলা–কথায় যেন মুক্তো ঝরে। তাকে দেখে, তার কথা শুনে ঈর্ষা হয়। ভাবি মানুষ কী করে এতো গুছিয়ে, এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারেন?
তার কাছে যাওয়া, একান্তে তার সাথে কথা বলা, বসে গল্প করা সে এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে সৌভাগ্য আমার হয়েছে বার তিনেক। প্রথম হল্যান্ডে, বাকি দু–বার দেশে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে। আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে তিনি এসেছিলেন ইউরোপ। সাথে বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী ও ফটো–সাংবাদিক বন্ধু তাহের, পুরো নাম এম এ তাহের। সবুজবাগের এক নম্বর গলিতে ঢুকতেই তাহেরের পৈতৃক নিজস্ব বাড়ি। সেই বাড়ির পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিতেই হাতের ডানে যে চারতলা বিল্ডিং তার উপরতলার দুটি কামরার ফ্ল্যাটে থাকতাম আমি। তখন বাংলাদেশ টাইমসসে সাংবাদিকতা করছি। সে–সময় থেকেই তাহের ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরতো। সেই থেকে তার সাথে আমার পরিচয় জানাশোনা ও বন্ধুত্ব, যা এখনো অটুট রয়েছে। এখন তো তাহের বাংলাদেশের নামীদামী আলোকচিত্রশিল্পী, দেশ–বিদেশ থেকে পাওয়া অনেক পুরস্কার ইতিমধ্যে তার ঝুলি ভারী করেছে। যাই হোক, ফোনে তাহের যখন জানালেন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সহ দিন কয়েকের জন্যে হল্যান্ড আসবেন এবং আমার বাসায় থাকবেন, তখন কোন দ্বিধা না করে সাথে সাথে জানিয়েছিলাম চলে আসতে। সালটা বোধকরি ২০১২ হবে। খুব সম্ভবত তখন ছিল সামার। ইউরোপে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে চমৎকার আবহাওয়া। থমাস এডিসনের আলোয়–ভরা আমার বাসা আরো আলোকিত হয়ে উঠেছিল জ্ঞানের–আলো ছড়িয়ে বেড়ানো, মানুষ–গড়ার কারিগর, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অবস্থানে। দিন চারেক ছিলেন তিনি আমাদের বাসায়। যে ক’দিন ছিলেন দিনের বেলায় এদিক–ওদিক বেড়িয়ে রাতের বেলায় ড্রয়িং রুমে বসে কিংবা ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে চলতো আড্ডা। আড্ডা ঠিক বলা যাবেনা। আড্ডা হয় যখন দু–পক্ষই কথা বলে। তিনি বলতেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ শুনতাম।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের রয়েছে ঈর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী কথা–বলার গুণ, বাগ্মিতা। তার হাস্যরস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তাৎক্ষণিক ও যে কোন বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার ক্ষমতা, জ্ঞানের গভীরতা, দেশপ্রেম, উচ্চারণ, উপস্থাপনের শৈলী– সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক কিংবদন্তী। তিনি যখন কথা বলেন তখন উপস্থিত সবাই তার বলা–কথার প্রতিটি শব্দ উপভোগ করেন। এশিয়ার নোবেল হিসাবে পরিচিত ‘ম্যাগসেসাই’ পুরস্কার পেয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ২০০৪ সালে। এর পর পেয়েছেন আরো অনেক পুরস্কার। তার মধ্যে অন্যতম একুশে পদক (২০০৫), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১১) এবং জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৭)। পুরস্কার প্রসঙ্গে অধ্যাপক সায়ীদ একবার বলেছিলেন, ‘আমি কখনো পুরস্কার বা নাম চাইনি। আমি চেয়েছি আনন্দের সাথে বাঁচতে। আমার গোটা জীবনে আমি আমার কাজের মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়িয়েছি। জনগণের কাছ থেকে সব সময় আমি কল্পনার বাইরের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার এই যে জীবন, এই জীবনে আমার কোন দুঃখ এবং হতাশা নেই’।
‘তার সাথে কথা হচ্ছিল তার ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ ভবনে তার অফিস কক্ষে, চলতি বছরের মে মাসের ২৮ তারিখ। বলা যেতে পারে হুট্ করে দেখা হওয়া। সেদিন দুপুর তিনটায় বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেশন (বিসিএসম)-র এ জি এম (বার্ষিক সভা) হবে ঢাকার এনজিও, রামরু অফিসে। অফিস বিজয়নগর। আমার অবস্থান মিরপুর। ঢাকার ট্রাফিকের উপর কোন ভরসা নেই। ভরসা নেই যাত্রীদের, ভরসা নেই চালকেরও। কেউ ঠিক করে বলতে পারেন না একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগতে পারে। আমার স্থায়ী তরুণ ও দক্ষ গাড়ি চালক সামাদকে যখন জিজ্ঞেস করি, মিরপুর থেকে বিজয়নগর পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে, তার উত্তর, ‘স্যার, ঢাকার জ্যাম তো, কিছু বলা যায় না। আজ রোববার, দোকান অফিস সব তো খোলা, এক ঘন্টাও লাগতে পারে, আবার বেশিও লাগতে পারে’। কোন রিস্ক না নিয়ে তাকে বলি, আমি আগেই রওনা দিতে চাই, কেননা নির্দিষ্ট সময়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হতে চাই। তার উপর রামরুর অফিস খুঁজে বের করতে হবে, যদিও বা ঢাকায় কোন ঠিকানা খুঁজে বের করার ভার পুরোটাই সামাদের। ঢাকা এখন অনেক বদলে গেছে। আমার আশির দশকে দেখা ঢাকা আর সে অবস্থানে নেই। সেদিন রাস্তায় যানবাহনের ভিড় তেমন ছিল না। সোনারগাঁ হোটেলের কাছাকাছি যখন পৌঁছি তখন সবে দেড়টা। ভাবি এই দেড়ঘন্টা কোথায় কাটাবো। এখান থেকে বিজয়নগর পৌঁছুতে বড় জোর মিনিট পনের থেকে বিশ, যদি যানবাহনের অস্বাভাবিক ভিড় না থাকে। সামাদকে বলি, সোনারগাঁ হোটেলে যান। ঠিক করি সেখানে চা/কফি খেতে খেতে কিছু সময় কাটা যাবে। হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ, যদিও বা তাতে ল্যাপটপের পরিবর্তে একটা বই, কলম, কাগজ ও পানির বোতল। লবিতে প্রচন্ড ভিড়। সব কিশোরী আর তরুণী, জনা কয়েক মাঝ–বয়েসী। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, কলকাতা থেকে এসেছে, নাচের দল।
সোনারগাঁ হোটেলে আসার আগে তাহেরকে ফোন করলে বলেন, তিনি আসছেন দেখা করতে। কিছুক্ষণ পর তাহের এলেন। চা, স্ন্যাকস অর্ডার দেবো। তাহেরের কথা, কেবল চা, এখানে যে দাম তা দিয়ে কিছু খাওয়ার কোন অর্থ হয় না। তার আপত্তি টেকে না। তখন তাহেরকে বলি, ‘সায়ীদ স্যারের সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। তাকে সদ্য প্রকাশিত বই, ‘হল্যান্ড থেকে’ দেয়া যেত। কথা বলছি এমন সময় তাহেরের ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে বলেন, ‘স্যার করেছেন’। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তাহের ফোন আমাকে ধরিয়ে দিলে অধ্যাপক সায়ীদকে বলি, ‘আগামীকাল চাটগাঁ যাবো, যদি আপনার সময় থাকে তাহলে আজ একবার দেখা করতে চাই, আমার সদ্য প্রকাশিত বইয়ের একটা কপি আপনাকে দিতে চাই’। মনে মনে ভাবি, দেখা হলে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ব্যাপারটাও সামনাসামনি বলতে পারতাম। তাহের ইতিমধ্যে তাকে (অধ্যাপক সায়ীদ) এই ব্যাপারে বলে রেখেছিলেন। আমার কথা শুনে উত্তরে তিনি বলেন, ‘শরীর খুব একটা ভালো নেই। ইদানিং অফিসে সব সময় আসিনা। ঠিক আছে, আপনি আজ বিকেল পাঁচটায় আসুন, আমি থাকবো’। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। যদিও বা টের পেলাম তাতে আমার যে এজিএম আছে, তাতে পুরোটা সময় থাকা সম্ভব হবে না। তারপরও ঠিক করি ওনার সাথে দেখা করাটা আমার কাছে কম জরুরি নয়। বরঞ্চ বেশি। তার কাছ থেকে সময় পাওয়া, তাও যদি হয় একান্তে, তাহলে তো কথা নেই। একটু বাদে তাহের তার গাড়ি নিয়ে বিদায় নিলেন। আমার ভরসা সামাদ, তাকে নিয়ে বিজয়নগর। রামরুর অফিস খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। ততক্ষণে প্রায় সবাই এসে গেছেন। একটু দেরি করে মিটিং শুরু হলো, বাংলাদেশের স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলোনা। পাঁচটার আগেই পৌঁছুতে হবে ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে’। মিটিংয়ের মাঝপথে, ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেবো, এমন সময় এলো খাবার। তখনও আমার লাঞ্চ করা হয়নি। রামরুর পরিচালক, অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘চলে যাবেন?, খেয়ে যান’। খেয়ে যেতে পারলে ভালো হতো, হাতেও সময় ছিল কিন্তু ওই যে ভয়, ঢাকার ট্রাফিক, আনপ্রেডিক্টেবল, কিছুই বলা যায় না। বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসি। এবারও কোন ভিড় পেলাম না। মিনিট পনেরর মধ্যে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট ঠিকানায়। গলি থেকে বেরিয়ে আসছে এক তরুণ ও তরুণী। তাদের জিজ্ঞাসা করতেই হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’।
‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র আজ আর শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি আজ একটি দেশব্যাপী আন্দোলন। আলোকিত জাতীয় চিত্তের একটি বিনীত নিশ্চয়তা। মানবজ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা এবং অনুশীলনের পাশাপাশি হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের বহুবিচিত্র কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে উচ্চতর শক্তি ও মনুষত্ব্যে বিকশিত হবার একটি সপ্রাণ পৃথিবী’– না, কথাগুলি আমার নিজের নয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে ধার করা। ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজের পেছনে শিক্ষা সমপ্রসারণ কেন্দ্রের ছোট্ট অডিটোরিয়ামে মাত্র ১৫ জনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল একটি ক্ষুদ্র পাঠচক্র। আজ তার শাখা–প্রশাখা গজিয়ে গোটা বাংলাদেশে এর সদস্য সংখ্যা পঁচিশ লক্ষ। ভাবা যায়? এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজকের লেখা শেষ করবো, তারই একটি কথা ধার করে। নাম উল্লেখ নেই, কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটি তার কথা। আর কেউ এভাবে বলতে পারেন না। “আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, পেরিক্লিসের আমলে, এথেন্সের যুবকদের আঠারো বছরে পদার্পণ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একটি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে হত। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হত। ‘আমি সারাজীবনে এমন কিছু করে যাব যাতে জন্মের সময় যে– এথেন্সকে আমি পেয়েছিলাম মৃত্যুর সময় তার চেয়ে উন্নততর এথেন্সকে পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পারি।’ আমাদের চেষ্টাও তেমনি এক উন্নততর বাংলাদেশের জন্য।”
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট