সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, গবেষণা, প্রস্তাবনা, সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৮ সনে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। ‘সড়ক পরিবহন আইন’ ২০১৮ ও ‘মহাসড়ক আইন‘ ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ‘যে লাউ সেই কদু’। দুর্ঘটনাও কমছে না, মৃত্যুর হারও কমছে না। ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’-র হিসাব বলছে, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৮ সনে ৪ হাজার ৪৩৯ জন, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ২২৭ জন, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯৬৯ জন এবং ২০২১ সালে ৪ হাজার ২৮৯ জন নিহত হয়েছেন। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়– ২০২১ সনে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন গত ৬ মে ২২ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ২৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত ১১ দিনে সারা দেশে ১৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন ৯৭ জন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় দিন দিন মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে।
প্রশ্ন হলো, কেন কমানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা? আর কেন কমছে না মৃত্যুর মিছিল ? এর উত্তরে বিস্তারিত লিখা যাবে, কিন্তু সেটা হবে একই কথার পুনরাবৃত্তি। তবে ইদানীং নতুন ভাবে দুর্ঘটনার নতুন কারণ ‘মোটর সাইকেল’ যুক্ত হয়েছে। ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতি’ নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, গত দুই বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন ১০ লাখ মোটরসাইকেল যুক্ত হয়েছে। এখন রাস্তায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ লাখ। অধিকাংশ মোটর সাইকেল চালক কম বয়েসি। তারা হেলমেট–প্রশিক্ষণ ছাড়া, বেপরোয়া গতিতে, নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই মোটরসাইকেল চালিয়ে থাকে, ফলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবি হয় এবং আহত বা নিহত হন। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক ড. শুভ প্রসাদ দাস জানান, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত রোগীদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন’। তিনি বলেন, ‘জরিপে ৩৭ ভাগ বলা হলেও বাস্তব চিত্র হবে ৫০– ৬০ ভাগ হবে’। চমেক হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগের একজন চিকিৎসকও দুর্ঘটনায় আহতদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিঙার আরোহি বলে জানান। মোটরসাইকেল বিষয়ক এক তথ্যে দেখা গেছে, ‘এক সময়ে জাপানে ২৫ লাখ মোটরসাইকেল ছিল, কিন্তু দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়াতে তারা কমিয়ে ১০ লাখে নিয়ে এসেছে। এতে তাদের দুর্ঘটনা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াতে মোটরসাইকেল কমিয়ে ফেলায় দুর্ঘটনা কমে গেছে বলেও জানা গেছে। অভিজ্ঞজনদের মতামত হলো, ‘মোটরসাইকেল অন্য যে কোনো যানবাহনের চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মহাসড়কে এই মোটর সাইকেল অন্য যানবাহনের জন্যও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন সংগঠন ও গবেষকদের গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রধানত যে সব বিষয় উঠে এসেছে তা হলো, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ও খামখেয়ালিপনা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, অরক্ষিত রেলক্রসিং, রাস্তায় ফুটপাথ না থাকা বা ফুটপাথ বেদখলে থাকা, অপর্যাপ্ত ট্রাফিক জনবল, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ছোট যানবাহন বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, ট্রাফিক সম্পর্কিত বিভাগ সমূহের সমন্বয়হীনতা, এলোপাতাড়ি রাস্তা পার হওয়া, মহাসড়কের পাশে হাট–বাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো। তা ব্যতিত, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন (বাস) ব্যবস্থার পরিবর্তে সিএনজি অটোরিকশা, টুকটুকি, ইজিবাইক, নসিমন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেপরোয়াভাবে বাড়ছে। বর্তমানে ৪২ সীটের বাসের পরিবর্তে তিনজন যাত্রীর অটোরিকশা গ্রামেগঞ্জের মানুষের অন্যতম বাহনে পরিনত হয়েছে। গ্রাম হতে শহরে আসার রাস্তায় বিপজ্জনক এই যানের বেপরোয়া চলাচল দেখলে গা শিউরে উঠে। অথচ ১০ বছর পূর্বেও গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্ট হতে শহরমুখি নিয়মিত গণপরিবহন (বাস সার্ভিস) ছিল, যা এখন নেই বললেই চলে। সে স্থানে এখন থ্রি হুইলারের দাপট বেড়েছে, বেড়েছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক সুপারিশ করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১. আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। ২. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো, মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন। ৩. দেশের সড়ক–মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) ও প্রয়োজনীয় স্থানে স্পীড ব্রেকার স্থাপন করা এবং জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন করা। ৪.পরিবহন চালকদের নিয়মিত পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ৫.পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম–দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা। ৬. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে আধুনিকায়ন করা। ৭. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। ৮. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া। ৯. ট্রাফিক বিভাগে জনবল বৃদ্ধি এবং ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা। ১০. পরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য সচিব, জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসকদের প্রতি মাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
উপরোক্ত সুপারিশ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনার বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে প্রতিরোধের জন্য নিম্নোক্ত সুপারিশ সমূহও যেমন– মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক সমুহে রোড ডিভাইডার স্থাপন করা, উল্টোপথে গাড়ি চলাচল কঠোর ভাবে বন্ধ করা, মহাসড়কে গাড়ির স্পীড লিমিট নিশ্চিত করা, শহর ও গ্রামাঞ্চলে যাত্রীবাহি বাস দাঁড়ানোর জন্য বাস বে তৈরি করা, ‘গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকায় রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রীজ নির্মাণ করা, ‘শহর এলাকায় ট্রাফিক বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ ও রাজউক/ সিডিএ–এর সমন্বয়ে ট্রাফিক সিস্টেম মনিটরিং কমিটি করা’, ‘রাস্তার মোড় গুলো হকার ও জটলা মুক্ত রাখা’, ‘মোটরসাইকেল চালকদের নিয়মের মধ্যে আনার উপায় বের করা’, ‘পরপর তিনবার ট্রাফিক আইন ভংগ করার জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স পাঁচ বছরের জন্য বাতিল করে দেয়া’, ‘ফুটপাত–রাস্তা অবৈধ দখল মুক্ত করা‘, ‘মহাসড়ক হতে হাটবাজার তুলে দেয়া’, ‘অরক্ষিত রেলক্রসিং গুলোতে গেইটম্যান নিয়োগ দেয়া’ – বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুহারের চিত্র আমাদের কষ্ট দেয়। ‘একটি দুর্ঘটনা, একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না’। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের পরিবার সারাজীবনই আর্থিক ও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে চলে। অথচ এমন একটি অতীব প্রয়োজনীয় ও স্পর্শকাতর সমস্যা আমরা সমাধানে পিছিয়ে আছি। অনেকের অভিযোগ–রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেও দুর্ঘটনা কমছে না। কিন্তু আমরা যদি দুর্ঘটনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে সিরিয়াসলি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করি, তাহলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু অনেক কমে আসবে। আশাকরি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহ এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।