হাজী মোঃ জাকারিয়া এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কৃতকর্মের অবদান স্বরূপ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একুশে স্মারক সম্মাননা পদক, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ পদক, সমাজ কল্যাণ ফেডারেশন প্রদত্ত স্বর্ণ পদক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। সেই সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের সাথে তিনি ছিলেন একজন উদ্যোক্তা। আমার জানা মতে হাজী মোঃ জাকারিয়া প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
হাজী মোঃ জাকারিয়া ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ৩৭ নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর। স্থানীয় জনগণের সমর্থনে দীর্ঘ ২২ বছর তিনি মুনির নগর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে থেকে রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনেক কাজ করেছেন।
হাজী মোঃ জাকারিয়া ৭৯ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে ৩ জুলাই ২০১৬, ১৯ শে আষাঢ় ১৪২৩, বেলা ১১.৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ছুটে যান হালিশহরে মুনির নগর ওয়ার্ডের মুন্সি পাড়ায় হাজী জাকারিয়ার বাড়িতে এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ান এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন।
পরদিন ৪ জুলাই ২০১৬ ভোর থেকেই বৃষ্টি আর বৃৃষ্টি। চট্টগ্রামের আকাশ ছিল কালো মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। কোথাও কোনো আলো নেই। মনে হয়েছিল এই পৃথিবী বুঝি মেঘাচ্ছন্ন আঁধারেই ঢাকা। তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। অনবরত পড়ছে তো পড়ছেই।
হাজী মো. জাকারিয়া যে নেই এই শূন্যতায় ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠি। তাঁর নামাজে জানাজায় যেভাবেই হোক আমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে। চট্টগ্রাম শহরের সব স্থান বৃষ্টির পানিতে সয়লাব। তারপরও আমি রওনা হলাম হালিশহরে। পোর্ট মার্কেটের পরেই রাস্তায় এক হাঁটু পানি জমেছে। চলাচল প্রায় বন্ধ। তারপর একটি রিঙা করে পানি ভেঙে রওনা হলাম। রিঙাওয়ালা অতি কষ্টে টেনে টেনে আমাকে নিয়ে গেল হাজী জাকারিয়ার বাড়িতে। লোকে লোকারণ্য। হাজী জাকারিয়ার বড় ছেলে হুরমুজ শাহ মোঃ বেলালের সাক্ষাৎ পেলাম। আমার পক্ষ থেকে তাকে সান্তনা দিলাম।
ইতিমধ্যেই তখনকার ক্ষমতাসীন মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিন, সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল আলম, চট্টগ্রাম মহানগরীর তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার নামাজে জানাজায় উপস্থিত হয়েছেন। মাইকে বার বার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল নামাজে জানাজায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর জন্য। বৃষ্টিও থেমে নেই। মুষলধারে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। আমি নিজেও ভিজে একাকার। নামাজের জানাজায় যাঁরা এসেছেন প্রত্যেকে বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। এর মধ্যেই হাজী মোঃ জাকারিয়ার নামাজে জানাজা সম্পন্ন হলো। বৃষ্টিস্নাত অবস্থায় সকলেই আল্লাহর দরবারে হাত তুলে হাজী মোঃ জাকারিয়ার আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া প্রার্থনা করলেন।
বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রামের সাথে হাজী জাকারিয়ার একটি সুন্দর সম্পর্ক ছিল। হাজী জাকারিয়ার মুন্সি পাড়া হাই স্কুলের ছেলে মেয়েদের বেতার প্রোগ্রামের মাধ্যমেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিকে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রচার কার্যক্রমে নারীদের ক্ষমতায়ন বিষয়ক বেতার প্রোগ্রামে মুন্সী পাড়া হাই স্কুল প্রাঙ্গণে ২০০০ সালে একটি বিশাল বেতার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী (প্রয়াত) এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। সেই সাথে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এম.আই চৌধুরীসহ অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
হাজী মোঃ জাকারিয়া ছিলেন একজন জন দরদী মানুষ। পাড়া মহল্লার সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর ছিল গভীর সখ্য। তাদের সুখে দুঃখে তিনি ছিলেন পরামর্শ দাতা এবং সাহায্যকারী।
বন্দর থানার অন্তর্গত প্রাকৃতিক শোভার ঐতিহ্যে লালিত জনঅধ্যুষিত এলাকা হালিশহর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার মরহুম এম এ আজিজের জন্মভূমি, আধ্যাত্মিক সাধক হযরত হাফেজ সৈয়দ মোহাম্মদ মুনিরুদ্দীন (রঃ), হযরত মৌলানা আবদুল গফুর শাহ (রঃ), আবদুল জলিল শাহ (রঃ) এর মত সাধক পুরুষদের পুণ্য জন্মভূমি হালিশহর মুনিরনগরে হাজী জাকারিয়া ১৯৩৪ সালের ৩০শে জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে বারিক মিঞা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে একই বছরে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন এবং গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত হন এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক শ্রম ও ত্যাগের ফলে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২২ বছর ৩৭নং হলিশহর মুনিরনগর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় এলাকার উন্নয়নে নতুন অবকাঠামো সৃষ্টি করেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ এলাকাবাসীর সুখে দুঃখে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন এলাকাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন, ভালোবাসা ও দোয়া।
১৯৭৬ সালে এলাকাবাসীর নৈতিক সমর্থন নিয়ে মুন্সীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে শিশুদের জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য কচি কথা প্রিপারেটরি স্কুল, ১৯৯৫ সালের ২৭ মার্চ, তাঁর দানকৃত জমির উপর হাজী জাকারিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৮০ সালে আলম বক্কর জাকারিয়া প্রিপারেটরি কেজি স্কুল, ২০০৮ সালে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম আনোয়ারা জাকারিয়া এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। হালিশহর মুন্সীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হালিমা-হাকিম শিশু বিদ্যালয়সহ হালিশহর ও বন্দর এলাকায় অসংখ্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নিজ এলাকা ছাড়াও হাজী মোঃ জাকারিয়া চট্টগ্রাম শহরের আয়ুব বিবি সিটি কর্পোরেশন স্কুল ও কলেজের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ, বারিক মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, ফজলুল হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, হালিশহর মুন্সীপাড়া নৈশ স্কুল (১৯৬১), ফিজিক্যাল এঙার্সাইজ কলেজ ও আল জাকারিয়া পাবলিক লাইব্রেরিসহ অনেক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, পৃষ্ঠপোষকতা ও জমিদাতা কিংবা পরিচালনা কমিটির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। হাজী মোঃ জাকারিয়া ৬০ শতক ভূমিদান করেন কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। উক্ত জমির উপর শিক্ষা বিস্তার ও এলাকাকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার জন্য নিজের মা-বাবার নামে জরিনা মফজল সিটি কর্পোরেশন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
হাজী মোঃ জাকারিয়া ছিলেন এলাকার উন্নয়নের রোল মডেল। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততোদিন হালিশহর ৩৭ নং ওয়ার্ডের সকল উন্নয়নের প্রাণপুরুষ হিসেবে শুধু কাজ করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রামে নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরী আইন-শৃঙ্খলা কমিটি, চট্টগ্রাম সিটি বাস, হিউম্যান হলার এসোসিয়েশননের ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত সম্পাদক ছিলেন। বন্দর ট্রাক মালিক অ্যান্ড কন্ট্রাক্টর এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন যানবাহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ, মাঝিরঘাট ট্রাক মালিক সমিতি, হালিশহর পতেঙ্গা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ রকম প্রায় শতাধিক সংস্থা, সংগঠন ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিজের জন্মভূমি হালিশহর মুনিরনগর ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষের নাগারিক সুবিধা বৃদ্ধিতে রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ নানা ধরনের উন্নয়নে হাজী মোঃ জাকারিয়ার অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা।
তিনি উন্নয়নের যে কার্যক্রম শুরু করেছেন সেই ধারাবাহিকতায় আগামীতেও নতুন পরিকল্পনায় হালিশহরকে আরো উন্নত করার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নূতন দিগন্ত সূচিত হবে। হাজী মোঃ জাকারিয়া যতটুকু উন্নয়ন রেখে গেছেন একদিন তাঁর মূল্যায়ন উন্নয়নের ইতিহাসে স্থান পাবে। হাজী মোঃ জাকারিয়ার ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার