কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সকলের সাথে এক হতে চান এবং সে ধরনের লোকজনের অভাব বর্তমানে প্রকট। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র এবং সেই অনুষঙ্গে নিজস্ব জৌলুস নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। সেই প্রেক্ষিতে আমরা ছিদ্দিক আহমদ মাস্টারকে পাই একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে। সমাজ জীবনের বহুমাত্রিক আঙিকে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি দক্ষতার সাথে তাঁর শিক্ষাপরিক্রমা চালিয়ে গেছেন। কুঁড়িদেরকে ফোটানোর সুমহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর মধ্যে আমরা একটি সুস্থ সামাজিক মনকে পাই। বর্তমানে আমরা তো মনের ঘরে অর্গল দিতেই ব্যস্ত। আমরা যে গ্রামীণ সমাজের কথা বলি, সেই সমাজে আজও অগ্রসরতা আসেনি। শুধু বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালালেই সত্যিকারের আলোক আসে না। তাঁর যুগে তিনি একটি অনগ্রসর সামাজিক অবস্থায় নিজের যোগ্যতাকে উজাড় করে দিয়েছেন। তাঁকে দেখার এবং সান্নিধ্যের সুযোগ আমার হয়েছিল। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত হাসিমাখা অবয়বে কথা বলতেন। তাঁর কথা-বার্তা ছিল একটি খোলা বইয়ের মতো। তিনি বুদ্ধির বেড়াজালে নিজেকে লুকাবার প্রয়াসী কখনো ছিলেন না। এ ধরনের লোক সকলের গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকেন।
তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের তিনটি আমলকে দেখেছেন- বৃটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আমল। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞাতায় সমৃদ্ধ ছিলেন। আমি এক সময়ে সমবায় সমিতির প্রশিক্ষণের বরাবরে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাতদিন ছিলাম। তিনিও ছিলেন। দেখেছি তাঁর মধ্যে শিশু সুলভ আচরণ ও যৌবনের কর্মচাঞ্চল্য। তিনি অন্ধত্ব: অলসতাকে জয় করেছিলেন। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এ ধরনের অনেকজন আছেন, যাঁরা কখনো প্রচারের উপায়কে স্বপ্নে ও চিনেননি। কিন্তু তাঁদের নিয়ে আলোচনা করা এ কারণে প্রয়োজন যে, সে সকল বনফুলদের ও স্বাভাবিক সৌন্দর্য ছিল, ছিল প্রকাশের তনময়তা ও বিকাশের সুন্দর আয়োজন।
তাঁর মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস সকল সময়ে কার্যকরী ছিল। তাঁর মধ্যে এ মানসিক সাহস ছিল যে, সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মদক্ষতাকে একটি আলোকধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজ গ্রাম দলইনগরে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তিনি সামাজিক সংযোগসহ সকল প্রেক্ষিতে বিস্তারিত থেকেছেন। সামাজিক সম্ভ্রববোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। সেই সম্ভ্রমপূর্ণ নীতিজ্ঞানের ওপর জনগণের সামাজিক শৃঙ্খলা, একতা ও বিশ্বাসকে তিনি এগিয়ে যাবার প্রেরণা হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রয়াসী ছিলেন। তিনি সফলকাম হয়েছিলেন বলেই মৃত্যুর পরও তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজন থাকছে। কারণ তাঁর জীবনকাল থেকে আমরা সুস্থ সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপট নিতে পারি।
তিনি ছিলেন সাধারণ জনগণের কাছের মানুষ। তাঁর স্বগ্রাম দলইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিদ্দিক মাস্টারের স্কুল হিসেবে বিশেষ পরিচিতিতে থেকেছে। সর্বশ্রেণির লোকজনের সাথে তাঁর মেলামেশা ছিল। ঐ গুণটি সকলের মধ্যে থাকে না। দেখা যায় যে, কৃষকের ছেলে লেখা-পড়া শেখে অন্যের প্রতি ক্রোধ প্রকাশে ‘চাষা’ বলে গালি তথা নিন্দাবাদ করে। তিনি শিক্ষিত ছিলেন। গুরু ট্রেনিংও নিয়েছিলেন। তাঁর মানসিকতা শেকড় বিহীন ছিল না। গ্রামীণ জীবনধারায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ছিল। এ ধরণের লোক বর্তমানে বিরল। তিনি একটি গতিবান কর্মময় জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি স্বধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনোরূপ গোঁড়ামী ছিল না। কায়িক পরিশ্রমের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তিনি রাজনীতির জনসেবার দিকটিকে সঙ্গ দিয়েছেন। নিজের সাধ্য সাপেক্ষ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সর্বাংশে তাঁর মধ্যে আমরা নৈর্বক্তিক মননশীলতাকে পাচ্ছি। তিনি দলইনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, গহিরা শান্তির দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ও ব্যাংক লি. এর সাবেক চেয়ারম্যান ও তৎকালীন গহিরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। এ কথা সর্বমহলে স্বীকৃত দীর্ঘদিন তিনি দলইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। রাউজানের গহিরা ইউনিয়নের দলইনগর গ্রামে খন্দকার হামিদ আলী মুন্সির বাড়ি মোহাব্বত আলী’র ওরসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর আর কোনো ভাই-বোন ছিল না। গ্রামের জায়গা-জমির উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সংসার চলতো। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি শিক্ষকতা জীবন বেছে নিয়েছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য। তিনি বিভিন্ন ট্রেনিং শেষ করে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন এবং দলইনগর প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। দীর্ঘদিন একই স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে তাঁকে তিন পুরুষের শিক্ষক হিসেবে জানতেন। অর্থাৎ ছেলের শিক্ষক, বাপের শিক্ষক ও দু’একজন দাদার শিক্ষকও হওয়ার বিরল সম্মানের সুযোগ পান। প্রতিটি ছাত্রের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান তাঁর জানা ছিল। তিনি শুধু স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না, সমাজের একজন অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে সমাজ গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞজনেরা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে স্থান দিতেন। আয় বলতে বিভিন্ন ফলের চাষ করতেন গহিরা কালাচাঁন চৌধুরী হাটে তাঁর একটি লাইব্রেরি ছিল। তিনি অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চলাফেরা করতেন।
২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর (৩রা রমজান, ইফতারের সময়) ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার (৯৯) বছর বয়সে অনেকটা সুস্থ অবস্থায় সকল কর্মমায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।