আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের আলোকে বাংলাদেশও এবছর দিবসটি উদযাপন করছে। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য মা ও শিশুর স্বাস্থ্য। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছরের জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়, ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এই সংগঠন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। এইদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস বলে নির্ধারিত হয়। প্রতিবছর সংস্থাটি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যা বিশেষ করে সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় এ দিবসটি।
মা ও শিশুর বিদ্যালয় পূর্ব বয়স পর্যন্ত প্রদেয় উন্নয়নমূলক, প্রতিরোধমূলক, আরোগ্য সহায়ক এবং পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্য সেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। যার মূল উদ্দেশ্য হলো : মাতৃ মৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু হার হ্রাস করা; প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন; পরিবারে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ; মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উপাদান সমূহ; মাতৃ স্বাস্থ্য; পরিবার পরিকল্পনা; শিশু স্বাস্থ্য; স্কুল স্বাস্থ্য; প্রতিবন্ধী শিশুর যত্ন; বিশেষ স্থানে শিশুর যত্ন যেমন, ডে–কেয়ার সেন্টারে শিশুর যত্ন।
কিন্তু এ বিষয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে সেবা দেওয়া হচ্ছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মকর্তার নিয়মিত উপস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের গড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকছে। সাপ্তাহিক কর্মদিবসের শেষদিন গত ১৩ মার্চ ২০২৫–এর তথ্য অনুযায়ী, এদিন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মী সবচেয়ে বেশি উপস্থিত ছিল সিলেট বিভাগে। সেদিন কর্মস্থলে উপস্থিত ছিল বিভাগটির ৬১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কর্মী। সবচেয়ে কম ছিল রংপুরে। বিভাগটির ৪৭ দশমিক ১৬ শতাংশ কর্মী সেদিন কর্মস্থলে হাজিরা দিয়েছে। এছাড়া বরিশালে ৫৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫৭ দশমিক ৫৪, ঢাকায় ৫১ দশমিক ৭৪, খুলনায় ৫৯ দশমিক ৪১, ময়মনসিংহে ৫৮ দশমিক ৭৬ ও রাজশাহীতে ৪৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ কর্মী উপস্থিত ছিল। ওইদিন সারা দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ৯২ হাজার ৫৫৩ স্বাস্থ্যকর্মীর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল ৪১ হাজার ৭২৪ জন বা ৪৫ শতাংশের কিছু বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের উপস্থিতির হার যদি এমন হয়, তাহলে স্বাস্থ্যখাতে খারাপ অবস্থা বিরাজ করা অস্বাভাবিক নয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারলেও স্বল্প আয়ের মানুষের চিকিৎসার প্রধান ভরসা হলো সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মীর অনুপস্থিতিতে এসব হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি বহুলাংশে বেড়ে যায়।
প্রতিবেদেন বলা হয়, বেসরকারি চেম্বার, বাড়তি চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ নিতে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কম বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রান্তিক অঞ্চলগুলোয় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য সহকারীদের পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধার অভাব, যাতায়াতের অসুবিধার কারণে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতির হার কম বলে স্বীকার করছেন তাঁরা। তাঁদের ভাষ্যমতে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বার্থে স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতনরা বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি মেনে নেন। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গেলে ঐসব হাসপাতালগুলোতে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি শতভাগ থাকা উচিত। কোনোরকমের অবহেলা কাম্য নয়।
বলা জরুরি যে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয়–এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই এইসব ক্ষেত্রে অর্জন সর্বোপরি যে কোনো বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা সহজতর হবে। স্বাস্থ্য অধিকারের দাবিতে দেশে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সারা বিশ্বের সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেক মানুষ, সর্বস্থানে এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অ্যাকসেস থাকতে হবে। এটি আমাদের জন্মগত অধিকার, এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু আমার পকেটে টাকা নেই বলে আমি স্বাস্থ্যসেবা পাব না, তা কিন্তু হবে না। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য একে অগ্রাধিকার দিতে হবে।